ভূবনজয়ী মহাকবি ফেরদৌসীর জীবনাদর্শন এবং মহাকাব্য শাহনামা
[পিডিএফ]

উপক্রমণিকা:
কবিরা সত্যের দর্পণ ও বেহেশতী বাগানের বুলবুল। সত্য চির-অম্লান ও চির সমুজ্জ্বল হয় বলে প্রকৃত কবিরাও দেশ আর কালের গন্ডী পেরিয়ে মানবজাতির অন্তরে চির-প্রজ্জ্বল হয়ে থাকেন অক্ষয় ধ্রুবতারার মত। হাকিম আবুল কাশেম ফেরদৌসী তুসি (ফার্সি: حکیم ابوالقاسم فردوسی توسی, ফেরদৌসী নামে বেশি পরিচিত (فردوسی); ।
মহাকালের পাখায় চির-অম্লান এমনই এক মহাকবি। এক হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে ক্ষণজন্মা এই কবির কালোত্তীর্ণ কাব্য “শাহনামা” বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাচীন কাব্য হিসেবে সমাদৃত হয়ে আসছে। বিশ্ব-বিশ্রুত এই কবির লেখনীর যাদুস্পর্শে জেগে উঠেছিল সাময়িকভাবে ঝিমিয়ে পড়া প্রতিভা-সমৃদ্ধ ইরানী জাতি। তিনি যে শুধু ইরানের জাতীয় জাগরণের কবি বা জাতীয় কবি ছিলেন তা নয়, বরং তার লেখনীর মোহনীয় স্পর্শে প্রাচ্যের স্তব্ধ-প্রায় কাব্য-রবিচ্ছবি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন আবারও হয়ে ওঠে প্রদীপ্ত ও প্রাণবন্ত। তাই ফেরদৌসী ও তার কীর্তি গোটা মানব সভ্যতার অমর ও অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক সম্পদ।
জন্ম ও বেড়ে উঠা:
তাঁর নাম মোহাম্মাদ আবুল কাশেম। তিনি ৯৪১ খৃষ্টাব্দে ইরানের তুস নগরের ‘বাঝ’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তুস নগরে এক সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে কত রকমের গোলাপ ফুটতো তার কোন লেখাজোখা নেই। বাগানটি ছিল আবার সেদেশের রাজার। এই বাগানের দেখাশুনা করতেন মোহাম্মাদ ইসহাক ইবন শরফ শাহ। তাঁরই পুত্র ছিলেন আবুল কাশেম। ছোট বেলায় আবুল কাশেম পিতার সাথে বাগানে ঘুরে বেড়াতেন।
সুন্দর সুন্দর ফুল দেখতে যেমন ভালো লাগে আবার সেগুলোর কি মনোমুগ্ধকর সুগন্ধী। তিনি প্রাণভরে ফুলের সুবাস নিতেন। গোলাপের বাগানে বেড়াতে বেরিয়ে আবুল কাশেম মুগ্ধ হয়ে যেতেন। উপরে চারপাশে নীল আকাশ। সবুজ গাছপালা। আর তার মাঝে ফুটে আছে ছোট বড় হরেক রকম গোলাপ।
জ্ঞানার্জন ও কাব্যচর্চা:
বাল্যকাল তিনি পিতার কাছে পড়ালেখা করেন। পরে তিনি স্থানীয় একজন পন্ডিতের কাছে জ্ঞান অর্জন করেন। পিতা রাজার বাগানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তাই তার কোনো অভাব ছিল না রাজার কাছ থেকে তিনি ‘তনখা’ হিসেবে যা কিছু পেতেন তাতে ভালভাবেই তার সংসার চলে যেত। ছোট বেলায় বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে তার কবিতা লেখার কথা মনে আসে।
বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে যায় একটা ছোট নদী। কোথা থেকে এত পানি আসে আবার কোথায় চলে যায়। এগুলো তার মনে রেখাপাত করে। নদীর ধারে কত পাথর পড়ে আছে। তিনি তারই একটার উপর বসেন আর প্রাকৃতিক এসব সৌন্দর্য্য উপভোগ করেন। এখানে বসে আবুল কাশেম কবিতা লেখেন।
বিত্ত-বৈভব:
পিতার অবস্থা ভাল ছিল। তিনি ইন্তেকালের সময় অনেক জমি জায়গা রেখে যান। কাজেই আবুল কাশেমের জীবন কাটানোর মত প্রয়োজনীয় অর্থের কোন অভাব ছিল না। তিনি প্রতি বছর এসব জায়গা জমি থেকে প্রচুর আয় করতেন।
কিন্তু ধন সম্পদের দিকে তার কোন নজর ছিল না। কোন রকমে খেয়ে পরে চলাটাই ছিল তার লক্ষ্য। তাঁর সাধনা ছিল ভাল ভাল কবিতা রচনার মাধ্যমে মানুষকে ভাল এবং কল্যাণের দিকে উদ্বুদ্ধ করা। সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করাই ছিল তার জীবনের মিশন। পিতামাতা শখ করে অল্প বয়সেই তাঁর বিয়ে দেন।
রাজার কোপানলের শিকার:
তার ঘরে মাত্র এক মেয়ে। মেয়েটিকে তিনি নিজের কাছে রেখে লেখাপড়া শেখান। সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের উপশম করতে চাইতেন। এসব খবর সে দেশের রাজার কানে গেল। তখনকার দিনে রাজার গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা এসব খবর রাখত। তারা কোন লোককে জনপ্রিয় হতে দেখলে রাজাকে জানিয়ে দিত। এর ফলে রাজা সেই লোককে সহ্য করতে পারতেন না। হয় তাকে সেদেশ ছেড়ে চলে যেতে হতো নয়তো রাজার সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হতো। আবুল কাশেম কোন ঝক্কি-ঝামেলা পছন্দ করতেন না। তিনি ভুবুক কবি। রাজা হওয়া তার লক্ষ্য নয়।
বরং কবিতা লেখা আর দুঃখী মানুষের দুঃখ দূর করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। রাজার কাছে তার বিরুদ্ধে অনেক রকম মিথ্যা অভিযোগ আনা হল। ফলে রাজা তাকে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা করেন। আবুল কাশেম সে খবর পেলেন। রাজ দরবারেও অনেক সভাসদ তাকে ভালোবাসতেন। তারা সময় মত তাকে রাজার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দিলেন।
সুলতান মাহমুদের শরণাপন্ন:
কাজেই আবুল কাশেম মেয়েকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তিনি গজনীতে গেলেন। সেখানকার সুলতান খুব ভাল লোক। তার নাম মাহমুদ। দেশ বিদেশের জ্ঞানী গুণী লোকজনকে মাহমুদ খুব সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। জ্ঞানী ও পন্ডিত লোকেরাও মাহমুদের কথা শুনে তার কাছে ছুটে আসতেন। রাজদরবারে বসতো কবিতা আবৃত্তির আসর।
আবুল কাশেম কবিতা রচনা করতেন। কাজেই তিনি ভাবলেন সুলতানের সাথে দেখা করতে পারলে তিনি যথাযথ কদর পাবেন। এজন্যেই তিনি গজনীতে আসেন কিন্তু সুলতানের সাথে দেখা করাতো আর চাট্টিখানি কথা নয়। মনে চাইলেই তো আর তার সাথে দেখা করা যায় না। এজন্য অনেক নিয়ম-কানুন রয়েছে। অনেক রকম কাঠখড় পুড়াতে হয়। সুলতানের দরবারে যারা কবি রয়েছেন। তারা সহজেই অন্য কবিকে তাদের মাঝে স্থান দিতে চান না। কাজেই রাজদরবারে প্রবেশের সুযোগ আর মেলে না।
আবুল কাশেম সুলতানের দরবারে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। কিন্তু সৎ লোকের সহায় থাকেন আল্লাহ্। আল্লাহর ইচ্ছায় সুলতানের উজির মোহেক বাহাদুর তাঁর প্রতি সদয় হলেন। মোহেকই আবুল কাশেমকে রাজদরবারে নিয়ে গেলেন।
‘ফেরদৌসী’ উপাধি লাভ:
সুলতানের সাথে আবুল কাশেমের প্রথম পরিচয় হল কবিতা পাঠের মাধ্যমে। সুলতান আবুল কাশেমের কবিতা শুনে মুগ্ধ হলেন। কবিতার ভাব, চিত্রকল্প, শব্দ চয়ন এত উচ্চস্তরের যে সুলতান বুঝলেন ইনি অনেক বড় মাপের কবি।
তিনি এ রকম একজন কবির জন্যই এতকাল অপেক্ষায় ছিলেন। তার বহুকালের প্রত্যাশা যেন আজ পূরণ হতে চলেছে। মাহমুদ মহাখুশী। তিনি নিজেও কবি ছিলেন। আবুল কাশেমের কবিতা শুনে তিনি তাকে ‘ফেরদৌসী’ উপাধি দিলেন।
বেহেশতের মধ্যে সবচেয়ে সেরা হচ্ছে এই জান্নাতুল ফেরদৌস। এই কবিও সকল কবির সেরা। তাই তাকে যথার্থই ফেরদৌসী বলা যায়। সুলতান আবেগ ভরে আবুল কাশেমকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন—
আয় ফেরদৌসি, তু দরবার মে ফেরদৌস কারদী।
এর মানে হল, হে ফেরদৌসি তুমি সত্যিই আমার রাজদরবারকে সেরা বেহেশতে পরিণত করে দিয়েছো। তখন থেকেই আবুল কাশেম ফেরদৌসি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হলেন। আবুল কাশেম নাম চাপা পড়ে গেল ফেরদৌসি নামের সামনে।
রাজনৈতিক কোন্দল:
সুলতান কবির জন্য আলাদা থাকার স্থান দিলেন। থাকা খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা করে দিলেন। আর তাকেই রাজকবি মনোনীত করলেন। আস্তে আস্তে ফেরদৌসীর সাথে সুলতানের ঘনিষ্টতা হল। দু’জনে প্রিয় বন্ধু হলে গেলেন। কবির জ্ঞান বুদ্ধিতে সুলতান খুবই মুগ্ধ হন।
কিন্তু তাদের এই বন্ধুত্ব স্থায়ী হলনা। ফেরদৌসীর প্রতি সুলতানের এত ভালোবাসা ও তার প্রতি এত সম্মান দেখে অন্যান্য কবি ও উজির নাজিররা ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। তারা কবিকে রাজদরবার থেকে বের করে দেবার জন্য গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দিও কবির বিরুদ্ধে গেলেন। তিনি গোপনে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
শাহনামা রচনা:
এদিকে সুলতান মাহমুদ কবির শাহনামা মহাকাব্য রচনা করার অনুরোধ জানান। এর প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দেবার ওয়াদা করেন। ফেরদৌসী ৩০ বছর পরিশ্রম করে শাহনামা রচনা করেন। এতে ৬০ হাজার শ্লোক আছে এবং এটি ৭টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত। এই কাব্যের কোথাও কোন খারাপ কথা নেই, নেই কোন বাজে উপমা।
ওয়াদার খেলাফ:
সুলতান শাহনামার জন্য কবিকে ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাইলেন। কিন্তু রাজদরবারের হিংসুটে কয়েকজন উজির সুলতানকে বললেন, এজন্যে কবিকে ৬০ হাজার রৌপ্যমুদ্রা দিলেই যথেষ্ট হবে। সুলতান তার সভাসদদের ভেতরের হিংসা বুঝতে পারেননি।
তারা যে ফেরদৌসীর প্রতি শত্রুতা করে তার ক্ষতি করতে চাইছে এটা তিনি ধরতে পারেননি। তাই তাদের পরামর্শ মত কবিকে ৬০ হাজার রৌপ্য মুদ্রা দেন। ফেরদৌসী সুলতানের ওয়াদাকৃত ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে রাগে, দুঃখে ও ক্ষোভে কি করবেন ভেবে পেলেন না। তিনি অর্থ বা ধন দৌলতের লোভে একাজ করেননি। বরং এই অর্থ দিয়ে দীন–দুঃখী মানুষের কল্যাণ করবেন এটাই ছিল তার আকাংখা। তিনি এটাকে তার জন্য অনেক অপমানজনক মনে করলেন।
অনুশোচনা ও প্রতিশ্রুতি পূরণ:
সুলতান তার ওয়াদা কবিকে ফেরৎ দেননি। কবি সুলতানের পাঠানো পত্রের এক কোনে আলিফ, লাম ও মীম এ তিনটি অক্ষর লিখে দেন। সুলতান মাহমুদ এ তিনটি অক্ষরের অর্থ বুঝতে পারলেন না। তার রাজদরবারের কেউই এর মর্ম উদ্ধার করতে পারলো না।
তখন তিনি রাজদরবারে ফেরদৌসীর অভাব অনুভব করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আজ যদি কবি ফেরদৌসী দরবারে থাকতেন তাহলে এর অর্থ তিনি অনায়াসে বলে দিতে পারতেন। অর্থ বোঝার জন্য রাজদরবারের বাইরে যেতে হতোনা।
সুলতান মাহমুদ এসময় কুহেস্তানের রাজা নাসরুদ্দিনের কাছ থেকে একটি পত্র পেলেন। পত্রে কবি ফেরদৌসীর খুবই প্রশংসা করা হয়েছে। সুলতান পত্র পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করলেন, কবি তার ওয়াদামত স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে দুঃখ পেয়েছেন।
রাজসভার অন্যান্য কবি এবং উজির-নাজিরও কবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল একথা বুঝতেও সুলতানের বাকী থাকল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দিকে রাজপদ থেকে বিতাড়িত করেন। আর কবিকে ফিরিয়ে আনার সংকল্প করেন। তিনি কবির প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রাসহ কবির জন্মভূমি তুস নগরীতে কবির বাড়ীতে দূত পাঠান।
কিন্তু তখন দেরী হয়ে গেছে। অভিমানি কবি ফেরদৌসীর তখন ইন্তেকাল হয়েছে। তাঁর লাশ দাফনের জন্য লোকজন কাঁধে করে যখন তাকে তার বাড়ী থেকে বের করছিলেন— সে সময় সুলতান মাহমুদের প্রেরিত দূত ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে কবির বাড়ীতে আসছিলেন।
কবি ফেরদৌসী ৯৪১ খৃষ্টাব্দে ইরানের তুস নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০২০ খৃস্টাব্দে এখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। পৃথিবীতে যে ক’জন হাতে গোনা মহাকবি রয়েছেন তিনি তাদের অন্যতম। বিভিন্ন ভাষায় তার মহাকাব্য শাহনামা অনূদিত হয়েছে। বিশ্বের কাব্য প্রেমিকদের কাছে তিনি চিরসবুজ চির নবীন এক মহাপুরুষ!
শাহনামার ক্যানভাসে:
উপকথা ও ইতিহাস পরস্পর মাখামাখি হয়ে আছে শাহনামাতে। সৃষ্টির শুরু থেকে আরবদের পারস্য অভিযান পর্যন্ত। কিছু চরিত্রকে কয়েকশো বছর জীবিত দেখা গেলেও সাধারণ ক্ষেত্রে আয়ু স্বাভাবিক। রাজা যায়, রাজা আসে। এক দৈত্যের মৃত্যু হয়, আরেক খলনায়ক জন্মলাভ করে। শুধু অপরিবর্তিত পারস্য নিজে। যেন সে-ই মূল নায়ক। পুরো শাহনামাকে তাই তিনটা ক্রমিক যুগে ভাগ করা যার। পৌরাণিক যুগ, বীরদের যুগ এবং ঐতিহাসিক যুগ।
১) পৌরাণিক যুগ:
এই অংশের পরিসর অপেক্ষাকৃত অল্প। শুরু হয় আল্লাহর প্রতি প্রশংসা প্রেরণের মাধ্যমে। সভ্যতার মৌলিক প্রয়োজনসমূহ ও তাদের উদ্ভাবনের বর্ণনা করা হয় এরপরেই। জামসেদের সাতশো বছরের রাজত্বকালে জাহহাক নামে এক দানবের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যার ধমণীতে আরব রক্ত ছিল।
তাকে পরাজিত করার জন্য আবির্ভূত হন ফারেদুন। ফারেদুনের আখ্যান বেশ রোমাঞ্চকর। তিনি গোটা পৃথিবীকে তিন ভাগ করে তিন পুত্র- ইরাজ, তুর ও সালমকে দিয়ে যান। ষড়যন্ত্র করে ইরাজকে হত্যা করে অপর দুই ভাই। ইরান ও তুরানের সংঘাতের সূত্রপাত এখান থেকেই।
২) বীরদের যুগ:
শাহনামার দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে বীরদের আখ্যান। ইরাজের পুত্র মনুচেহের থেকে শুরু। পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে দেরি করেন না মনুচেহের। তার সময়ে সাম নামক এক বীরের কথা জানা যায়।
মনুচেহেরের পুত্র জাল প্রেমে পড়েন রুদাবার। তাদের সন্তান রুস্তম শাহনামায় স্থান পাওয়া সমস্ত বীরের থেকে বেশি শক্তিশালী। বিভিন্ন রাজত্বকালে তার আয়ু তিনশো বছরেরও বেশি। মনুচেহেরের রাজত্বকালে জন্ম নিয়ে গুশতাস্পের সিংহাসন আরোহন পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন। শাহ এসফানদিয়ারকে হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যা করা হয়। রুস্তমের অধিকাংশ বীরোচিত কাজ সংঘটিত হয় শাহ কাউসের আমলে। শিয়াউসের সময়কালেও অব্যাহত থাকে তা। পুত্র সোহরাবের সাথে রুস্তমের যুদ্ধ ও সোহরাবের দুঃখজনক মৃত্যু সবথেকে বেশি জনপ্রিয় আখ্যানগুলোর একটি।
সে যা-ই হোক, ইরান-তুরান সংঘাত আবার তেতে ওঠে শাহ কাউস এবং তার পুত্র শিয়াউসের বিবাদের কারণে। শিয়াউস পালিয়ে গিয়ে তুরানের রাজা আফরাসিয়াবের কাছে আশ্রয় নেয়। প্রথমে আফরাসিয়াব নিজ কন্যার সাথে শিয়াউসের বিয়ে দিলেও পরে অসন্তুষ্ট হয়ে হত্যা করেন। সেখানেই বেড়ে ওঠে পুত্র কায় খসরু। আফরাসিয়াবকেও প্রতিদানে হত্যা করা হয়। আখ্যানের এই অংশে সংযুক্ত বিজান ও মনিজাহর প্রেমকাহিনী।
কায় খসরুর পর কাইয়ানিদ বংশের সমান্তরাল শাখার লোহরাস্প সিংহাসনে আরোহন করেন। তার পুত্র গোশতাস্প বিয়ে করেন পূর্ব রোমের সিজারের মেয়েকে। তার আমলেই পুত্র এসফানদিয়ার কর্তৃক সমর্থিত জরাথুস্ত্র তার নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। এসফানদিয়ারের মৃত্যু হয় রুস্তমের হাতেই। তারপর দারিউস ক্ষমতায় আসেন। দারিউসের রাজত্বকাল শেষ হলে ইসকান্দার (আলেকজান্ডার)- এর অভিযান শুরু হয়। তার কিছু দুঃসাহসিক অভিযানের উপকথার বিবরণের সাক্ষাৎ মিলে।
৩) ঐতিহাসিক যুগ:
ইসকান্দারের পরেই আরদাশিরের প্রসঙ্গ আসে। আর সেই সাথে শাহনামা তার রচনার ঐতিহাসিক অংশে প্রবেশ করে। যদিও বিক্ষিপ্তভাবে কিছু উপকথা স্থান পেয়েছে, তথাপি এ পর্যায়ে ঐতিহাসিক সত্যতার মাত্রা নেহাত মন্দ না। আরদাশিরের পর শাপুর, বাহরাম, খসরু এবং কোবাদের মতো শাসকদের উত্থান-পতন ও ক্ষমতার টানাপোড়েন অত্যন্ত যত্নের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
শেষ শাহ ইয়াজদিজার্দের সময়কালে জনৈক সেনাপতি দ্বিতীয় রুস্তমের পরিচালিত বাহিনীর সাথে আরবদের সংঘর্ষ ঘটে। কাদেসিয়ার এই যুদ্ধে পতন ঘটে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার করে রাখা ইরানীয় সাম্রাজ্যের। আরবদের অভিযান ও সংঘর্ষকেও সাবলীল নাটকীয়তার ভেতর দিয়ে চিত্রিত করেছেন মহাকবি ফেরদৌসি। তারপর কিছু সংখ্যক তারিখসহ দীর্ঘ কাহিনীর সমাপ্তি টানা হয়েছে একটা সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে।
চরিত্র চিত্রণ:
ছোট ছোট কাহিনী নিয়ে রচিত উপাখ্যানটি সংযোজিত হয়েছে খুবই আলাদাভাবে। ইতিহাসের কাহিনীর উপযুক্ত কালক্রম অনুসরণ করা হয়নি। বছরের পর বছর ধরে কাহিনীগুলো প্রচলিত ছিল। গঠন পর্যালোচনা করে অবাক হতে হয় প্রায়শঃ। মূলত শেক্সপিয়ারের ভাষা ও শাহনামার ভাষায় রয়েছে অদ্ভুত মিল। মিলনাত্মক ও বিয়োগাত্মক— উভয় নাটকীয় ধাঁচই বিদ্যমান। ইতিহাসের উৎস থেকে উদ্ভিদবিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা। খুব সাবলীলভাবে উঠে এসেছে। রাজা ও বীরদের জন্য বিলাপ এবং সূর্যোদয়ের বর্ণনাকে উচ্চ শৈল্পিক মাত্রায় নিয়ে গেছেন তিনি। এ দুয়ের জৈবিক যোগসূত্র দ্বৈত-সঙ্গীতের মতো প্রবাহিত হয়।
পুনরাবৃত্তির ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকার জন্য ফেরদৌসী বেছে নেন শক্তিশালী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-আঙ্গিক। প্রয়োগ করা হয় কাব্য শিল্পের পূর্ণ শক্তিকে। তাই প্রতি দুটি সূর্যোদয়ের দৃশ্য কিংবা প্রতি দুটি বীরের জন্য শোকগাঁথা একরকম নয়। অস্ত্রের ঝনঝন, বীরে বীরে সংঘাত, জন্ম-মৃত্যু, শিকার কিংবা কামকেলি- সবকিছুকে ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে কবির জন্মভূমি ইরানের গল্প। সেই গল্প কেবল মাটিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এসেছে সমুদ্র এবং আকাশও। অভিযানমুখর রাজারা যেখানে জমিনে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে ভূমিকা পালন করেন। বেঁচে থেকে যুদ্ধ করেন শত শত বছর। সমগ্র কাব্যে জাতীয় শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা উপস্থাপিত হয়েছে ভালো আর মন্দের মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসাবে। যেখানে দিনশেষে ভালোরই জয় হয়।
এবং তারপর:
শাহনামাতে সময়ের ব্যবধানে ৫০ জন শাসকের উত্থান-পতনকে তুলে আনা হয়েছে, যা শুরু হয়েছিল প্রথম মানুষ কাইয়ুমারস থেকে এবং শেষ হয়েছে ইয়াজদিজর্দের পতনের মধ্য দিয়ে। ছয় হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেন পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে না বসে, অনেকটা এজন্যই ফেরদৌসীর প্রয়াস।
শাহনামা ফার্সি ভাষাকে যে ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে গেছে, এক হাজার বছর পরেও তা অপরিবর্তিত। এই জন্যই মহাকবি গ্যাটে ফার্সি সাহিত্যের সুনাম করে লিখে গেছেন তার West-East Divan। এজন্যই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল সাদী, জামী, রুমি, হাফিজ, আত্তার কিংবা সানাইয়ের মতো পরবর্তী দুনিয়া কাঁপানো ফার্সি কবিরা। দ্বাদশ শতকের কবি খাকানি যথার্থই বলেন—
বিষাদ গূঢ় অন্ধকারে জ্ঞানীর গাঢ় বাতি
ফেরদৌসীর কথার সাথে তুল্য শুধু তাই;
ফেরেশতাদের মতোন সেই তীব্র অনুভূতি
অমন করে লিখবে যারা ফেরেশতা তারাই।
বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন অনুবাদ থাকলেও বাংলা ভাষায় শাহনামার সবথেকে প্রামাণ্য অনুবাদ ৬ খণ্ডে প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। প্রাঞ্জল এই অনুবাদ প্রায় ১৭ বছর সময় নিয়ে করেছেন মনিরউদ্দীন ইউসুফ ‘ফেরদৌসীর শাহনামা’ নামে।
# লেখকের রচিত গ্রন্থাবলীর (PDF) কালেকশন সমগ্র:
[নিচের তালিকাবদ্ধ বইয়ের নাম হতে আপনার প্রয়োজনীয় পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করতে যেকোন একটি সার্ভারের ডাউনলোড লিঙ্ক বেছে নিন।]
১. ফেরদৌসীর শাহনামা (১ম খণ্ড) – মনিরউদ্দীন ইউসূফ অনূদিত
Download: 1. Drive Link ||
২. ফেরদৌসীর শাহনামা (২য় খণ্ড) – মনিরউদ্দীন ইউসূফ অনূদিত
Download: 1. Drive Link ||
৩. ফেরদৌসীর শাহনামা (৩য় খণ্ড) – মনিরউদ্দীন ইউসূফ অনূদিত
Download: 1. Drive Link ||
৪. ফেরদৌসীর শাহনামা (৪র্থ খণ্ড) – মনিরউদ্দীন ইউসূফ অনূদিত
Download: 1. Drive Link ||
৫. ফেরদৌসীর শাহনামা (৫ম খণ্ড) – মনিরউদ্দীন ইউসূফ অনূদিত
Download: 1. Drive Link ||
৬. ফেরদৌসীর শাহনামা (৬ষ্ঠ খণ্ড) – মনিরউদ্দীন ইউসূফ অনূদিত
Download: 1. Drive Link ||
[ বি: দ্র: ] বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। আমাদের সাইটের কোন বই ভালো লাগলে অনুগ্রহপূর্বক মূল বইয়ের হার্ডকপি লাইব্রেরী হতে সংগ্রহ করুন।
মনে রাখবেন, আপনার ক্রয়কৃত বই প্রেরণা যোগায় লেখক ও প্রকাশককে নতুন বই প্রকাশ করতে। লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সমাজকে সুসমৃদ্ধ করার প্রয়াসে মূল বই ক্রয়ের কোনো বিকল্প নেই।
অনলাইনে বই ক্রয়ের জনপ্রিয় কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম –