খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ খুররম জাহ মুরাদের জীবনালোচনা
এবং রচিত গ্রন্থবলী [পিডিএফ]

ভূমিকা:
প্রথাগত মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও উপমহাদেশের যে সব মনীষী ইসলামী পুনর্জাগরণে বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দিয়েছেন খুররম জাহ মুরাদ তাদের মধ্যে প্রধান কয়েকজনের একজন। খুররম মুরাদ আধুনিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ শিক্ষিত; পেশায় একজন প্রকৌশলী। ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি উঁচু মানের ইসলামী সাহিত্য রচনা করে চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তাঁর যুগোপযোগী চিন্তা, আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার সমাধান সম্বলিত সাহিত্য এবং প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ বক্তব্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষন করেছে।
জন্ম, পরিচয় ও শিক্ষাজীবন:
খুররম মুরাদের জন্ম ভারতের মধ্য প্রদেশের রাজধানী ভূপাল শহরে। পিতা মনজুর আলী মুরাদের ঔরসে মাতা বেগম আনাতুল হাইয়ের গর্ভে জন্ম ক্ষণজন্মা এ মনীষীর। তাঁর জন্ম সন ১৯৩২ইং। ভূপাল শহরেই খুররম মুরাদের প্রাথমিক শিক্ষার উত্তরণ ঘটে। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর মুরাদ পরিবার পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়।
১৯৪৮ সনে করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন খুররম মুরাদ। ১৯৫২ সালে সেখান থেকে ১ম স্থান অধিকার করে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। পরবর্তীতে উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকা গমন করেন। আমেরিকার মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম. এস. সি. ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন:
শিক্ষা সমাপ্তির পর ইঞ্জিনিয়ার খুররম মুরাদ Associate council Engineer এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হয়ে ঢাকায় আসেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালনে তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন। এসময় তিনি এদেশের অনেকগুলো বড় প্রকল্পে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করেন; যার অন্যতম হচ্ছে ঢাকা শহর রক্ষা বাঁধ ও ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-ডেমরা বাঁধ (DND)।
পরবর্তীতে তিনি কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন লন্ডন শহরকে। একজন আন্তর্জাতিক মানের প্রকৌশলী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন তিনি। লন্ডন, তেহরান, রিয়াদ, করাচি, ঢাকা প্রভূতি শহরে তিনি বৃহৎ প্রকল্পসমূহের ডিজাইনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পবিত্র কাবা ঘরের দরজা:
১৯৭৫ সালে সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে প্রকৌশলী মুরাদ মক্কা শরীফ গমন করেন। কাবা শরীফের মসজিদুল হারামের প্রাথমিক নকশা, বর্ধিত অংশের বিদ্যুতায়ন ও জমজম কূপের পানি উত্তোলন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনার প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে পারার সৌভাগ্য অর্জনকে তিনি তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন বিবেচনা করেন। এ মহান দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করার শোকরিয়া স্বরূপ তিনি কোন পারিশ্রমিক নিতে রাজি হননি। এক্সটেনশন কাজের ডিজাইন জমা দিয়ে মুরাদ বললেন—
“আপনি আমাকে দিতে চেয়েছেন এটা আপনার বদান্যতা। আমি এর পুরস্কার পরকালে আল্লাহর কাছ থেকে নিতে চাই এটা আমার বদন্যতা”
এ ভালোবাসার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ মসজিদুল হারামের একটি দরজার নামকরণ করেন তাঁর নামে ‘বাবে মুরাদ’।
ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও সংগঠক:
কৃতিত্বপূর্ণ ছাত্রজীবনের পাশাপাশি খুররম মুরাদ ছাত্রদের অঙ্গনে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮ সালে ইসলামী জমিয়তে তালাবা (ইসলামী ছাত্রসংঘ)’র প্রতিষ্ঠাকালীন দায়িত্বশীলদের একজন তিনি। ছাত্রসংঘের তিন সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে তিনিও একজন।
১৯৫১ সালে জমিরতে তালাবা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে কার্যক্রম হিসেবে কার্যক্রম শুরু করলে খুররম মুরাদ এর প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন; উল্লেখ্য ১৯৪৮ সালে জমিয়তে তালাবার কাজ শুরু হলেও ১৯৫১ সালের আগ পর্যন্ত সংগঠনটি জামায়াতে ইসলামীরই একটি উইন্ডো হিসেবে কাজ করত। খুররম মুরাদের নেতূত্বেই ছাত্রদের অঙ্গনে ইসলামী আন্দোলনের কাজ সাংগঠনিক রূপ পায়।
তিনিই ইসলামী ছাত্র সংগঠনের সংবিধান ও কর্মপদ্ধতির প্রাথমিক প্রণেতা বা রচয়িতা। কেউ স্বীকার করুক অথবা নাই করুক প্রকূত সত্য এই যে, বাংলাদেশে বর্তমান ইসলামী আদর্শের পতাকাবাহী সকল ছাত্র সংগঠন কিছুটা পরিবর্তন পরিবর্ধনসহ খুররম জাহ মুরাদ প্রবর্তিত ফরমুলা বা কর্মপদ্ধতিতেই তাদের সংগঠন পরিচালনা করছে।
ছাত্রত্ব সমাপ্তির পর খুররম মুরাদ জামায়াতে ইসলামীর সদস্য হন। ছাত্র সংগঠন পরিচালনার অভিজ্ঞতার কারণে তিনি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জামায়াতেরও নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমীর মনোনীত হন। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে স্থিত থাকেন।
পরবর্তীতে জামায়াতের তরবিয়ত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আরও পরে পাকিস্তান জামায়াতের নায়েবে আমীর মনোনীত হন এবং আমৃত্যু তিনি এপদে বহাল থাকেন। দায়িত্ব পালনকালে অতুলনীয় সাংগঠনিক প্রজ্ঞার আলোকে তিনি সাংগঠনিক মজবুতি, দাওয়াতের বিস্তৃতি এবং জনশক্তির মান উন্নয়ন ও মান সংরক্ষনে সচেষ্ট থাকতেন। দ্বীনি দায়িত্ব পালনকালে তাঁকে বাতিলের রোষানলে পড়তে হয়েছে বারংবার। ১৯৬৪ ইং সালে তিনি তিন মাস কারাবাস করেছেন। ১৯৭১ সালে পুনরায় কারারুদ্ধ হয়ে বিনা বিচারে প্রায় তিন বছর ভারতের কারাগারে বন্দীত্ব জীবন অতিবাহিত করেন।
আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব:
পেশাগত কারণে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি খুররম জাহ মুরাদ দায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে পেয়েছেন বিশ্বব্যাপী পরিচিতি। তাঁর বক্তৃতা ও সাহিত্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে সমানভাবে সমাদর পেয়েছে। দাওয়াতী কাজে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে।
দেশে দেশে পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনসমূহ তাকে পরামর্শক মনে করতেন এবং তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ করতেন। তাঁর দাওয়াহ কার্যক্রম চিন্তাশীল মননে আবেদন সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে যুব সমাজে তাঁর বক্তৃতা ও সাহিত্য ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলনের মেধাবী তরুণদের বাছাই করে তিনি বিশেষ তরব্যিয়তের ব্যবস্থা করতেন। পরবর্তীতে তাঁর এসকল ছাত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইউরোপে ইসলাম প্রচারে তিনি অসামান্য অবদান রাখেন। তিনি দাওয়াতে ইসলাম ইউকে, ইসলামিক ফোরাম ইউরোপ প্রভৃতি সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সাহিত্যিক ও সুবক্তা:
ভাষার লালিত্য, অনুপম উপমা, হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপন বিষয় নির্বাচনে বিচক্ষণতা, যৌক্তিক বিশ্লেষণ, কুরআন হাদীসের প্রচুর ও যথার্থ রেফারেন্স আধুনিক মনে আবেদন সৃষ্টির পারদর্শিতা খুররম মুরাদের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য। উর্দু ও ইংরেজী উভয় ভাষায় লিখেছেন তিনি। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা মৌলিক ও অনুবাদ মিলিয়ে চল্লিশটির মতো। সংখ্যার বিচারে হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু তাঁর সাহিত্য সম্ভার মানের দিক দিয়ে অতুলনীয়। বাংলা ভাষায় তাঁর অসাধারণ গ্রন্থাবলীর বেশ কয়েকটি অনূদিত হয়ে ব্যাপক পাঠকনন্দিত হয়েছে। খুররম মুরাদের রচনাবলীর তালিকা নিম্নরূপ—
বাংলায় অনূদিত
১. খুররম মুরাদের শেষ অসিয়ত (খুররম মুরাদ কী আখেরী আসিয়াত)
২. কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা
৩. মূল্যবোধ, ক্ষমতা ও সমাজ পরিবর্তন: ইসলামী কর্মকৌশল
৪. ইসলামী পূর্ণজাগরণে শিক্ষকের ভূমিকা
৫. রমজানের পয়গাম (পয়গামে রমজান)
৬. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক (বাহামী তাআল্লুকাত)
৭. ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলি (তাহরিকে ইসলামী মে)
উর্দু ভাষায় রচিত
৮. জিকরে এলাহী
৯. রব ছে মুলাকাত
১০. আমানতদারী
১১. বাহামী তাআল্লুকাত
১২. তাহরিকে ইসলামী মে
১৩. দাওয়াত কে নিশানে রাহ্
১৪. রিযকে হালাল
১৫. আল্লাহ ছে মুহাব্বাত
১৬. হাছদ আওর বুগ্জ
১৭. হাকীকতে যুহ্দ
১৮. নিয়ত আওর আমল
১৯. হুব্বে দুনিয়া
২০. উরুজ কা রাস্তা
২১. দিল কি জিন্দেগী
২২. গলতিউন কো মাফ করনা
২৩. খুররম মুরাদ কী আখেরী আসিয়ত
২৪. এইটি এই ইসলাম আওর মুআল্লিম
২৫. পয়গামে রমজান
সাহিত্যের পাশাপাশি বক্তৃতা আলোচনার জগতে খুররম মুরাদ অপ্রতিদ্বন্দী। তাঁর বক্তব্য ও আলোচনার চার শতাধিক অডিও ভিডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম তরুণদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কয়েকদিন ফজরের নামাজের আগে তিনি আলোচনা পেশ করেছিলেন, যা ‘সুবেহ সাদিক’ শিরোনামে প্রকাশিত হলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
প্রিয় উক্তি:
“উদ্দেশ্য বা নিয়ত হল আমাদের আত্মার মত অথবা বীজের ভিতরে থাকা প্রাণশক্তির মত। বেশীরভাগ বীজই দেখতে মোটামুটি একইরকম, কিন্তু লাগানোর পর বীজগুলো যখন চারাগাছ হয়ে বেড়ে উঠে আর ফল দেওয়া শুরু করে তখন আসল পার্থক্যটা পরিস্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে। একইভাবে নিয়ত যত বিশুদ্ধ হবে আমাদের কাজের ফলও তত ভালো হবে।”
“কেউ যদি কুরআনের শরণাপন্ন হওয়া সত্ত্বেও অন্তরে সংস্পর্শ না লাগে, হৃদয় আলোড়িত না হয়, জীবন অপরিবর্তিত থেকে যায়, খালি হাতে ফিরেন, যেভাবে এসেছিলেন ঠিক সেভাবেই প্রত্যাবর্তন করেন, তাহলে তার চেয়ে মর্মান্তিক দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে? ”
ইন্তেকাল:
১৯৯৬ সালে এ মহান মনীষী দুনিয়ার সফর শেষ করে আলমে আখিরাতে পাড়ি জমান। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুর সময় তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তারিখ ছিল ১৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ৯ শাবান ১৪১৭ হিজরী।
মরহুম খুররম মুরাদ চার পুত্র আহম্মাদ ইমরান মুরাদ, হাসান সোহেব মুরাদ, ফারুক সালমান মুরাদ, ওয়ায়েস তাইয়্যেব মুরাদ এবং দুই কন্যা ফারাহ তাসনীম ও ফায়েজাকে রেখে যান।
# লেখকের রচিত গ্রন্থাবলীর (PDF) কালেকশন সমগ্র:
[নিচের তালিকাবদ্ধ বইয়ের নাম হতে আপনার প্রয়োজনীয় পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করতে যেকোন একটি সার্ভারের ডাউনলোড লিঙ্ক বেছে নিন।]
১. ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক – খুররম জাহ মুরাদ
Download: 1. Drive Link ||
২. ইসলামী নেতৃত্বের গুণাবলী – খুররম জাহ মুরাদ
Download: 1. Drive Link ||
৩. কুরআন অধ্যয়ন সহায়িকা – খুররম জাহ মুরাদ
Download: 1. Drive Link ||
৪. খুররম মুরাদের শেষ অসিয়ত
Download: 1. Drive Link ||
৫. খোশ আমদেদ মাহে রমযান – খুররম জাহ মুরাদ
Download: 1. Drive Link ||
৬. সুবহে সাদিক – খুররম জাহ মুরাদ
Download: 1. Drive Link ||
[ বি: দ্র: ] বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। আমাদের সাইটের কোন বই ভালো লাগলে অনুগ্রহপূর্বক মূল বইয়ের হার্ডকপি লাইব্রেরী হতে সংগ্রহ করুন।
মনে রাখবেন, আপনার ক্রয়কৃত বই প্রেরণা যোগায় লেখক ও প্রকাশককে নতুন বই প্রকাশ করতে। লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সমাজকে সুসমৃদ্ধ করার প্রয়াসে মূল বই ক্রয়ের কোনো বিকল্প নেই।
অনলাইনে বই ক্রয়ের জনপ্রিয় কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম –
- https://rokomari.com
- https://boibazar.com
- https://bookhousebd.com
- https://wafilife.com
- https://ruhamashop.com