দেশবরেণ্য আলেম ও সাহিত্যিক আল্লামা ইসহাক ফরিদী (রহ.)-এর জীবনালোচনা

ও গ্রন্থাবলী [পিডিএফ]

প্রভাতিকা:

আমাদের এই ধরণী সৃষ্টির পর থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছে মহাকালের আবর্তে। বৃত্তাকার পৃথিবী বেঁধে দেওয়া অমোঘ নীতিতে পরিভ্রমন করছে একই পথ ও গতিতে। ভোরে কচি আলো ছড়িয়ে উদিত হয় যে সূর্যশাবক সন্ধ্যায় তাই আলোর বহুরঙ্গা আলপনা এঁকে হারিয়ে যায় দিগন্তের ওপারে। ঝলমলে দিবসের সমাপ্তিতে আসে আঁধারের রাত।

নক্ষত্রের ছামিয়ানা, জোছনার প্লাবন শেষে আবারও দিনের উঁকিঝুকি। এটাই সময়ের চক্র। চক্রে কখনো ব্যত্যয় ঘটেনি। কেয়ামত পর্যন্ত ঘটবেও না। সময়ের এই একঘেয়ে প্রবাহকে অর্থবহ করার জন্যে মহান স্রষ্টা কালের পাঁকে পাঁকে কিছু মহামানব প্রেরণ করেছেন। যাদেরকে আমরা নবী বা আল্লাহর দূত হিসেবে জানি।

মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিরোধানের মধ্য দিয়ে এই দূতদের আগমনের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত হলে সূচনা হয় নতুন আরেক ধারাবাহিকতার। আল্লাহ তাঁর দ্বীনের কার্যসিদ্ধীর জন্যে কালে কালে প্রেরণ করেন এমন কিছু লোক যারা নববী চিন্তা ও চেতনাকে লালন করে তা বাস্তবায়নে উৎসর্গ করেন নিজের জীবন।

দ্বীনের মশাল প্রোজ্জ্বলমান রাখতে লড়ে যান আমৃত্যু। ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শীতা যাদের চলার পাথেয়। তাকওয়া যাদের শঙ্কাকুল পথের হাতিয়ার। সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ যাদের জীবনের সাধনা। আর প্রভুর তরে শাহাদাত তাদের পরম প্রার্থনা।

এমনই বৈশিষ্ট্যে মতি হয়ে উনিশ’শ সাতান্ন সালের ৫ জুন বুধবার পিতা আব্দুস সালাম ও মাতা সাকিনা বেগমের আঠারো বছরের বৈবাহিক জীবনের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগমন করে একটি ছোট্ট শিশু। ইবরাহীম ও সারা আলাইহিমাস সালামের দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনের শূন্যতা ঘুচিয়ে জন্মগ্রহন করেছিলেন যে পবিত্র শিশু তাঁর নামানুসারে এই শিশুরও নাম রাখা হয় ইসহাক।

শৈশব

বালক ইসহাকের শৈশব কাটে আদরে আদরে। মক্তবে যাওয়ার বয়স হলে যথারীতি  সেখানে যাতায়াত শুরু করেন। গ্রামের মসজিদের ইমামের কাছে পড়ে শেষ করেন কায়দা আমপাড়া। স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সাথে তিনি শেষ করেন কুরআনের নাযেরাও।

এরপর বালক ইসহাককে তার পিতামাতা কুরআনের হাফেজ হওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেন পাশ্ববর্তী গ্রাম ইমামপুরের হাফেজ আব্দুল হামিদের কাছে। যিনি হামিদ হাফেজ সাহেব নামেই সকলের কাছে সুপরিচিত। আশ্চর্য স্মৃতিধর ইসহাক অতি অল্প সময়েই কুরআন মুখস্থ করে ফেলেন।

কুরআনের হাফেজদের মাঝে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উঁচ্চতায়। এক বসাতেই তিনি শুনিয়ে দিতে পারতেন পুরো কুরআন। মৃত্যুর পূর্বেও তার কুরআনের ইয়াদ ছিল সদ্য হাফেজের মতোই।

নববী জ্ঞানে প্রাজ্ঞতা অর্জনের সুতীব্র বাসনা নিয়ে কিশোর ইসহাক পাড়ি জমান নারায়নগঞ্জের দেওভোগ মাদরাসায়। নিজের মেধা, চেষ্ঠা ও সাধনার বলে অল্পদিনেই দৃষ্টি কেড়ে নেন সকলের। শ্রেণির প্রথম স্থানের অধিকারটি তিনি নিয়ে নেন নিজের আয়ত্বে।

প্রতিটি ক্লাসের প্রতি পরীক্ষায় তার মাথায়ই অলঙ্কৃত হতো শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। ঘড়ির কাটা ধরে জল গেলার মতো শুনিয়ে দিতেন মীযান নাহুমীরের মতো কিতাব।

এরপর তিনি দেওভোগ মাদরাসা থেকে চলে আসেন যাত্রাবাড়ী মাদরাসায়। সেখান থেকে তার পা পড়ে ঢাকার ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদে। ফরিদাবাদ মাদরাসা ছিল তখনকার ঢাকার শ্রেষ্ঠ উস্তাদ শিষ্যদের অবস্থানস্থল। এখানে এসেও তিনি তার শ্রেষ্ঠত্বের ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন। মুখতাসার কিতাবের ইবারত পড়তেন মুখস্থের মতো।

তার একজন উস্তাদ বলেন, ক্লাসের প্রথম দিনেই একজন ছাত্র সকল সাথীদেরকে টেক্কা দেয়ার মতন পড়ার সুযোগটি নিজের দখলে নিয়ে বেশ উঁচু, স্পষ্ট এবং শুদ্ধ উচ্চারণে নির্ভুলভাবে ইবারত পড়ে আমাকে মুগ্ধ করে ফেলে। আমি বিস্ময়ের সাথে ছেলেটির দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম।

আমার অন্তরে তখন এমন আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভূত হচ্ছিল যে, তা ভাষায় ব্যাক্ত করার মতো নয়। তখন থেকেই আমার দৃষ্টি সেই ছেলেটির প্রতি নিবদ্ধ হয়ে যায়। তাঁর ভবিষ্যত নিয়ে আমার যে আস্থা ও ধারণা তৈরি হয় তা যে শুধু অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে তাই নয় বরং আমার ধারণাকেও ছাড়িয়ে যায়।

ছাত্র ইসহাক সম্বন্ধে তার সকল উস্তাদের অনুভূতি ছিল একই। যদিও সেই অনুভূতি একেক জনের বক্তব্যে বিবৃত হয়েছে একেক শব্দে। পরবর্তীতে ছাত্র ইসহাক যে কর্ম ও গ্রহণযোগ্যতায় আপন উস্তাদকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন তারও স্বীকৃতি এসেছে উস্তাদের মুখেই। তার খাটিয়াকে সামনে নিয়ে একজন বলেছিলেন, ‘ছেলেটা আসল। দেখতে দেখতে সে আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। আমরা মাটিতেই রয়ে গেলাম।’

ফরিদাবাদ থেকে ইসহাক চলে গিয়ে কিছুদিন ছিলেন স্বামীবাগের অস্থায়ী মাদরাসায়। মেশকাত দাওরা পড়েন জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে। দাওরায় বেফাক বোর্ডের মেধা তালিকায় অর্জন করেন প্রথম স্থান। দাওরা শেষ করার পর কৈশোরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যে মার কাছে গিয়ে অনুমতিস্বরে বলেন, মা! আমি দেওবন্দে যেতে চাই।

কিন্তু একমাত্র সন্তানের অনিশ্চিত অনিষ্টের শঙ্কাকাতর মা উত্তরে বলেন, ‘বাবা! তোমার দেওবন্দে যেতে হবে না। আমি তোমাকে দোয়া দিয়ে দিব। তুমি দেওবন্দে না পড়েও তার মর্যাদা লাভ করবে।’

মায়ের সেই কথা নবীন আলেম মাওলানা ইসহাকের জীবনে কিভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল তা তো আজ ইতিহাস। অনেকে তো বলেন— মা বাবা আর উস্তাদের প্রতি পারস্পরিক হৃদ্যতা ও দোয়াই অনুল্লেখ্য ইসহাকের মহীরুহ হওয়ার মূল নেয়ামক।

কর্মজীবন

জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে দাওরা শেষ করার পর উস্তাদগণ মাওলানা ইসহাকের যোগ্যতা ও প্রজ্ঞতার কারণে সেখানেই তাকে শিক্ষক হিসেবে রেখে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে কুমিল্লার জামিয়া কাসিমুল উলূম মাদরাসায় নিয়োগকৃত তার এক সাথীর আব্দার ও নাছােড়বান্দা মনোভাবের কারণে তার সাথে মাওলানা ইসহাককেও পাঠনো হয়।

তিনি যখন কাসিমুল উলূম মাদরাসায় গমন করেন তখন তা ছিল কাফিয়া জামাতে সীমাবদ্ধ। এক বছরেই সেখানকার পরিবেশকে সজীব করে সেটাকে দাওরা হাদীসে উন্নীত করার পেছনে যারা ক্লান্তিহীন নিরলস পরিশ্রম করেছেন তাদের মাঝে ‘ঢাকার হুজুর’ পরিচিতি পাওয়া মাওলানা ইসহাক ছিলেন অগ্রগণ্য।

এই মাদরাসাই মাওলানা ইসহাকের ছাত্রগড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিতি লাভের প্রথম ক্ষেত্র। এখানেই তার চেতনা যোগ্যতা সমকালীন বিষয়ে সচেতনতা আদর্শিক প্রেরণা এবং মননশীলতার বিকাশ ঘটে। শিক্ষাদানে বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী মাওলানা ইসহাক সকলের মাঝে সৃষ্টি করে বিস্ময়ানুভূতি।

ছাত্রদের প্রতি মমতা আদর্শ যোগ্য ছাত্র গড়ে তোলার ব্যাকুল প্রচেষ্টা এবং জ্ঞানগর্ভ সাবলীল পাঠদানের দ্বারা অল্প সময়ের মাঝেই প্রতিকূল পরিবেশকে জয় করে নিয়েছিলেন তিনি। এই মন্ত্রগুলো দিয়েই তিনি পরবর্তীতে নিজ এলাকায় রওযাতুল উলূম কাউনিয়াকান্দি মাদরাসা, পীরজঙ্গি মাদরাসা, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা এবং সর্বশেষ চৌধুরী পাড়া মাদরাসায় তৈরি করেছেন অসংখ্য সুযোগ্য ছাত্র।

শিক্ষক হিসেবে তিনি যেমন ছিলেন দৃষ্টান্তহীন; তেমনি প্রিন্সিপাল হিসেবেও ছিলেন অনন্য। পদ বা মর্যাদার লোভে তিনি চাটুকারিতার দ্বারস্থ হননি। ক্ষমতার মসনদ কখনও তাকে অধিনস্তদের প্রতি স্বেচ্ছাচারী হতে প্ররোচিত করেনি। খাদেম কেরানির প্রতিও ছিল তার উদার দৃষ্টি। ফলে সকলেই তার প্রতি পোষণ করত অকৃত্রিম ভালোবাসা আর মমতা। সকলকেই তিনি দিতেন কাজের স্বাধীনতা।

যে কাজে যে দক্ষ ও পারদর্শী তার থেকে সে কাজই আদায় করে নিতেন সুনিপুণভাবে। তিনি ছিলেন রত্ম চেনার মুহুরী। জাত চিনতে ও তার কদর করতে কখনো তার ভুল হতো না। কর্মজীবনের কিছু দিন ঢাকার শাহজাহানপুরের ঝিল মসজিদের ইমাম ও খেতাবাতের দায়িত্বও পালন করেন। ছিলেন মিফতাহুল উলূম মধ্যবাড্ডা, দেওভোগ ও চৌধুরী পাড়া মাদরাসার শায়খুল হাদীস।

অসংখ্য মসজিদ মাদরাসা দ্বীনী প্রতিষ্ঠান চলত তাঁর তত্ত্বাবধানে। একশত মাদরাসা প্রতিষ্ঠা— তার আমৃত্যু অতৃপ্ত স্বপ্ন। কলিমউল্লাহ কওমি বিশ্ববিদ্যালয় সেই স্বপ্নেরই একটি পালক। যা এখন ইসহাক ফরিদী (রহ.) কমপ্লেক্স নামে চলমান।

কর্মজীবনে কর্মের খাতিরে তিনি যেখানেই গিয়েছেন গড়ে নিয়েছে সেখানকার লোকদের সাথে গভীর হৃদ্যতা। শতব্যস্ততার মাঝেও এদেরকে তিনি নিজে কুরআন পড়াতেন; দান করতেন দ্বীনের সাধারণ শিক্ষা। শুনে আশ্চর্য হতে হয়— শিক্ষায় গতি ও আগ্রহী করার জন্যে এদের মাঝেও তিনি চালু করেন পুরষ্কৃত করার ফলপ্রসু রীতি। এইসব সাধারণ ভক্ত ও অনুরক্তদের দ্বারাও বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা ও দ্বীনী প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।

সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি ও বক্তৃতা

বাংলাসাহিত্যে আলেমদের পশ্চাদপদতা তাকে ব্যথিত করে তুলেছিল সেই ছাত্র বয়সেই। যখন কাফিয়া শরহে বেকায়ার ছাত্র তখন থেকেই তিনি বাংলার সাথে হৃদ্যতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হোন। শুধু নিজেই নয় সাথে একদল ছাত্র ভাইকেও বাংলা ভাষায় পারদর্শী করার মন্ত্রণায় করেন দীক্ষিত।

বাংলাভাষী লেখক আলেমদের শূন্যপ্রায় সংখ্যাকে সমৃদ্ধ, করার জন্যে নিজের সাথে নিয়ে নেন একঝাঁক তরুণকেও। পরবর্তীতে শিক্ষকতার সময়েও তার চেষ্টার এই ধারা অব্যাহত থাকে। ফলে তার যোগ্য তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠে একদল লেখক আলেম। যারা আজ বাংলাভাষায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত; লিখনীর মাধ্যমে দ্বীনের খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন কর্ম ও পরিবেশে।

আল্লামা ইসহাক ফরিদী (রহ.) বহু কর্মের পাশাপাশি লিখনীর কাজও করে গেছেন নিরলসভাবে। মাত্র বাইশ বছরের সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনে করেছেন সত্তরেরও অধিক বই রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ। ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বরেণ্য লেখক, গবেষক ও সম্পাদক।

গবেষণাধর্মী লেখায় বেশি মনোযোগ দেয়ার কারণে ইসলামী পত্রিকাগুলোতে তার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যহারে ঘটেনি। কুরআন, হাদীস, ফেকাহ, সংস্কৃতি, দাওয়াত, দাঈ, ইতিহাস, আধ্যাত্ম্য, জীবনী, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যাংকিং, সামাজিক জীবনসহ বিভিন্ন বিষয়ে রচনা করে গেছেন প্রমাণ্যগ্রন্থ।

সরল বিন্যাসে, বাহুল্যকে সচেতনভাবে এড়িয়ে আলোচ্য বিষয়ের বিন্যস্ত বিশ্লেষণের অবতারণা করতেন কুরআন, হাদীস ও যুক্তিভিত্তিক পর্যাপ্ত দলীল প্রমাণের আলোকে। প্রাঞ্জল বয়ানের সাথে শব্দের হালকা কারুকাজ তার লেখার বৈশিষ্ট্য। তার রচনা সকল শ্রেণির পাঠকের জন্যেই সহজপাচ্য। ধারাবাহিক ছন্দরীতির অনুসরণ না করলেও পড়তে গিয়ে তার রচনার পাঠককে ছন্দ পতনের হোঁচটও খেতে হয় না কোথাও।

লেখালেখির ক্ষেত্রে তার বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হল, খুঁটিনাটি নিখুঁত তথ্যসহ সকল রচনাই থাকত স্মৃতিতে গাঁথা। লেখার জন্যে তার কোনো ‘মুড’ এর প্রয়োজন হতো না। যেকোনো অবস্থা পরিস্থিতি ও পরিবেশে তার কলম চলত অবিরল।

কলমের মতো তার মুখেও ছিল স্রোতিস্বিনীর গতি। যেকোনো বিষয়ে তিনি বক্তৃতা দিতে পারতেন উপস্থিত নোটিশে। গেঁথে রাখা মালার মতো যখন তার মুখ থেকে নিঃসৃত হতো বিন্যস্ত শব্দের মুক্তা তখন মনে হতো বিষয়টা বুঝি মুখস্থ করেই এসেছেন।

স্থায়ী ভাঙ্গা স্বরেও তার সাবলীল স্পষ্ট বক্তৃতা সকলকেই আকৃষ্ট করত। তিনি কখনো সময় নষ্ট করতেন না। গল্পগুজবে অপচয় করতেন না মূল্যবান জীবন। ঘড়ির কাটার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতেন। যেন সময়কে হারিয়ে দেয়াই তার পরম লক্ষ্য।

রাজনীতিক সংগঠন ও সেবা

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান— এটা একটি আপ্তবাক্য। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক জীবনের সকল বিষয়ের নির্দেশনা রয়েছে এই ধর্মে। অন্যায়ের প্রতিবাদ, জুলুমকে রুখে দাঁড়ানো আর ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে হলে একজন পূর্ণাঙ্গ মুমিনের পক্ষে রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখার অবকাশ নেই।

এ সরল সত্য কথাগুলোর উপলব্ধি ইসহাক ফরিদী (রহ.)-এর এসেছিল ছাত্রসময়েই। ছাত্রাবস্থায়ই ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রসমাজ নামে নেযামে ইসলামপার্টির অঙ্গসংগঠনের সাথে। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি পালন করেছেন হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর খেলাফত আন্দোলনের কুমিল্লা জেলার সভাপতিত্বের দায়িত্ব। ছিলেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহকারী সম্পাদক।

সর্বস্তরের উলামায়ে কেরামের সমন্বয়ে একুশ শতকের প্রারম্ভে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি নামে যে সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে তিনি ছিলেন তার যুগ্মমহাসচিব। ছিলেন ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় নেতা। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় এখানেও তার উদারমনোভাব পরিলক্ষিত।

ভোগ নয় ত্যাগকেই গ্রহণ করেন তার রাজনীতির আদর্শ হিসেবে। ইসলামী দলের সকলের কাছেই তিনি ছিলেন সমাদৃতজন। কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে প্রায় সময়ই তিনি সমন্বয়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন। সকল ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও দলকে একমঞ্চে সমবেত করাকে তিনি নিয়েছিলেন ঈমানী ব্রত হিসেবে।

শুধু রাজনৈতিক নয়, অনেক অরাজনৈতিক সংগঠনেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা ও পরামর্শদাতা। ছাত্রাবস্থায় ভবিষ্যত পৃথিবীর নেতৃত্বদানে যোগ্য আদর্শবান ও যোগসচেতন একটি কাফেলা তৈরি করতে তার আরও কয়েকজন সহপাঠীসহ গড়েন ইসলামী ছাত্রঐক্য পরিষদ।

পরবর্তীতে তার উস্তাদদের নেগরাণীতে লাজনাতুত ত্বলাবা নামে যে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে তিনি তারও ছিলেন সম্মুখ পুরুষ। উনিশ’শ সাতানব্বই সালে ফিদায়ে মিল্লাত আসআদ মাদানী (রহ.) এর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সেবামূলক সংগঠন ইসলাহুল মুসলিমীনের ছিলেন যুগ্মমহাসচিব।

নিজের এলাকা গজারিয়া উপজেলাতেও তিনি গঠন করেন বিভিন্ন সংগঠন। এলাকার আলেমদের যৌথবদ্ধভাবে থাকার নিমিত্তে সর্বশেষ গঠিত সংগঠন হলো— হেফাজতে মুসলিমীন পরিষদ। বড় হয়ে যাওয়ার পর নিজ এলাকাকে ভুলে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতার বিপরীতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।

সর্বদাই তিনি জন্মস্থান নিয়ে ভাবতেন। এলাকার মানুষকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসা; বাতিল বেদআত কুসংস্কারকে বিতাড়িত করার জন্য তার ব্যকুলতা হৃদয়ে নাড়া দেয়ার মতো। একটি নাস্তিকতামুক্ত ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেশি বেশি নূরানী মক্তব প্রতিষ্ঠার কথা বলার সাথে সাথে নিজ এলাকায় তা বাস্তবায়নও করেছেন। ব্যবস্থা করেছেন মসজিদে মসজিদে বয়স্ক কুরআন শিক্ষারও।

গ্রামে যখন তার আগমন ঘটত, খবর পেয়ে তার ঘর ভরে যেত দারিদ্র অসহায়দের আনাগোনায়। কাউকেই তিনি খালি হাতে বিদায় দিতেন না। বিভিন্ন দূর্যোগে সাহায্যসামগ্রী নিয়ে তার আগমন ঘটত সর্বাগ্রে। এছাড়াও দুস্থদের স্বাবলম্বী করার জন্যে গবাদিপশু, বাহন ইত্যাদি বিতরণ করতেন।

নির্মাণ করে দিতেন মাথাগোঁজার আশ্রয়— ঘরও। বৃক্ষরোপন ছিল তার স্বভাবজাত সখ। যখনই গ্রামে যেতেন বাজার থেকে কিনে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন ধরণের গাছের চারা। আল্লামা ইসহাক ফরিদী— এ এক বিস্ময়কর চরিত্র!

উদারতা ও বদান্যতা: 

উদারতায় তিনি যে ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ— তা তার কাছাকাছি যে যত বেশি অবস্থান করেছে সে তত দৃঢ়তার সাথে তা স্বীকার করেছে। তার সাধারণ অনুগ্রহে কতজন যে আলেম হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। আর বাবার দায়িত্ব নিয়ে যাদের জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যায়ভার বহন করেছেন তাদের সংখ্যাও কি গুনে শেষ করা যাবে? তিনি আপ্যায়ন করতেন হৃদয় উজাড় করে।

চেনা অচেনা সকলের জন্যেই ছিল তার দস্তরখানা উন্মুক্ত। দাওয়াতে তিনি সাধারণত শূন্যহাতে যেতেন না। হাদিয়া গ্রহণ নয় হাদিয়া প্রদানও যে একজন আলেমের বৈশিষ্ট্য সারাজীবন তিনি তাই করে দেখিয়েছেন। জীবনে বিপুল অর্থ উপার্জন করলেও তা তিনি বিলিয়েছেন সিদ্দীকী চেতনায়।

তার একমাত্র আশ্রয় গ্রামের ঘরের মলিন বেশভূষা সকলকেই অবাক করে। ভবিষ্যতের ভার তিনি দিয়ে রাখতেন রিযিকের মালিকের কাছে। ওয়া মাই ইয়াতা ওয়াক্কাল আলাল্লাহি ফাহুওয়া হাসবুহ্যে আল্লাহর উপর ভরসা রাখে তিনিই তার জন্যে যথেষ্ট তার ভবিষ্যতদর্শন।

আধ্যাতিকতা ও খেলাফত লাভ

দিনভর লেখালেখি, পাঠদান এবং অন্যান্য কর্মব্যস্ততা শেষে মধ্যরাতে শয়ন করলেও প্রভুর প্রেম ও পরকালের ভয় শেষরাতে তাকে ঠিকই জাগিয়ে দিত। শেষরাতের ঘুমকাতর পৃথিবীতে তার নামাজ-যিকিরে সৃষ্টি হতো অন্যরকম আবহ। ব্যাকুল ক্রন্দনে প্রভাবিত হয়ে আশপাশের সকলে শামিল হতো তার সাথে।

একজন মানুষ প্রভুর কাছে কত দোয়া করতে পারে, কত কাঁদতে পারে তা আল্লামা ইসহাক ফরিদী (রহ.)-কে না দেখলে উপলব্ধি করা যাবে না। ইসলামের মহান সৌন্দর্য্য তার চরিত্রে কী সহজভাবে যে ফুটে উঠেছিল চিন্তা করলে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।

পরনিন্দা-দোষচর্চাকে বিষের মতোই হন্তারক মনে করতেন। তার সামনে এ ধরণের কিছুর অবতারণা হলে বলতেন— কাজের কথা বলো। সত্যি কথা বলতে, যদি ইসহাক ফরিদী (রহ.)-এর মাঝে তাজদীদী গুণের দাবি করা হয় তা অত্যুক্তি হবে না নিশ্চয়ই!

তিনি হজরত আসআদ মাদানী (রহ.)-এর হাতে প্রথমে বায়আত গ্রহন করেন। এরপর নানুপুরের পীর হজরত শাহ জমিরুদ্দীন (রহ.)-এর হাতে বায়আত গ্রহন ও তার থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন। মৃত্যুর পর দোয়া কবুলের নিমিত্তে তাকে অসিলা করে শায়খ জমিরুদ্দীন নানপুরী (রহ.) দোয়া করতেন।

আধ্যাতিক জগতে তার কবুলিয়্যাতের বিষয়টি এতেই অনুমিত হয়। ইসহাক ফরিদী (রহ.) বলেছেন— ইমাম আবু হানিফা (রহ.) আল্লাহর নূরকে নিরানব্বই বার দেখে থাকলে আমি একবার হলেও দেখেছি। তিনি মৃত্যুর পূর্বের রাতেও আল্লাহর রাসূলকে (ﷺ) স্বপ্নযোগে দেখার স্বীকারোক্তি করে গেছেন। তার এই স্বীকারোক্তি অহংকারপ্রসূত নয়। কেননা সরলতাই তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য।

বিবাহ ও সন্তানাদি

হেয়াদাতুন্নাহু জামাতে পড়াকালীন, যৌবনের সূচনাতেই মা-বাবা একমাত্র পুত্রসন্তানকে বিয়ে করিয়ে দেন। জালালাইন জামাতের বছর জন্মগ্রহণ করে প্রথম সন্তান। ছয় মেয়ে এক ছেলের তিনি গর্বিত পিতা। বাংলাদেশের ইসলামী সাহিত্যের তুমুল জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মাদ যাইনুল আবিদীন তার মেঝ জামাতা।

ইসহাক ফরিদী (রহ.)-এর সফল জীবন রচনার নেপথ্যের একটি কারণ তার অল্পবয়সের বিবাহও। এই স্বীকারোক্তি এসেছে তার জবানিতেই। এতে দ্রুত তিনি জীবনে সুস্থিরতা লাভ করেন। আর কাজের জন্যে সুস্থির মনেরই যে সবচে প্রয়োজন তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না।

শাহাদাত :

তিনি শাহ জমিরুদ্দীন নানুপুরীর কাছ থেকে খেলাফত লাভের কিছুদিন পর শায়খের সাথে সাক্ষাৎ এবং নিজের সর্বশেষ লিখিত ইহসান তাওউফ ও আত্মশুদ্ধি গ্রন্থটি শায়খের হাতে অর্পনের জন্যে চট্রগ্রাম রওনা হন। গমন পথেই রোড এক্সিডেন্টে ৫ ই জুন, ২০০৫ ঈসায়ী সনে মাত্র উনপঞ্চাশ বছর বয়সে শাহাদাত লাভ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

তিনি প্রায়ই বলতেন, মুমিনের জিন্দেগী আমৃত্যু জিহাদের জিন্দেগী, জিহাদ তার কর্মসূচী, শাহাদাত তার স্বপ্ন’। আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই স্বপ্ন অপূর্ণ রাখেননি। শাহাদাতের মৃত্যুঞ্জয়ী সুধা পান করিয়ে প্রিয় বান্দাকে করেছেন অমর। আল্লামা ইসহাক ফরিদী— এক মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘য়ালা দ্বীনের এই প্রহরীকে জান্নাতুল ফেরদাউসে সুউচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করুন। আমীন।।

 

 


# লেখকের রচিত গ্রন্থাবলীর (PDF) কালেকশন সমগ্র:

[নিচের তালিকাবদ্ধ বইয়ের নাম হতে আপনার প্রয়োজনীয় পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করতে যেকোন একটি সার্ভারের ডাউনলোড লিঙ্ক বেছে নিন]

১. আশরাফুল হিদায়া (১ম খণ্ড) – মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (র.)

Download: 1.      Drive Link            ||

২. আশরাফুল হিদায়া (২য় খণ্ড) – মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (র.)

Download: 1.      Drive Link           ||

৩. আশরাফুল হিদায়া (৩য় খণ্ড) – মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (র.)

Download: 1.      Drive Link           ||

৪. আশরাফুল হিদায়া (৫ম খণ্ড) – মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (র.)

Download: 1.      Drive Link           ||

৫. আশরাফুল হিদায়া (৬ষ্ঠ খণ্ড) – মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (র.)

Download: 1.      Drive Link           ||

৬. আশরাফুল হিদায়া (৯ম খণ্ড) – মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ফরিদী (র.)

Download: 1.      Drive Link           ||

 

[ বি: দ্র: ] বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। আমাদের সাইটের কোন বই ভালো লাগলে অনুগ্রহপূর্বক মূল বইয়ের হার্ডকপি লাইব্রেরী হতে সংগ্রহ করুন।

মনে রাখবেন, আপনার ক্রয়কৃত বই প্রেরণা যোগায় লেখক ও প্রকাশককে নতুন বই প্রকাশ করতে। লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সমাজকে সুসমৃদ্ধ করার প্রয়াসে মূল বই ক্রয়ের কোনো বিকল্প নেই।

অনলাইনে বই ক্রয়ের জনপ্রিয় কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম –

  1. https://rokomari.com
  2. https://boibazar.com
  3. https://kitabghor.com
  4. https://wafilife.com
  5. https://ruhamashop.com

ক্রেডিট
আবু সাঈদ
Back to top button
error: Python Encryption !!!