কালজয়ী মুজাদ্দিদ সিরাজুল হিন্দ শাহ্ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.)-এর জীবনালেখ্য

এবং গ্রন্থাবলী [পিডিএফ]

 

পুষ্প কাননের পাশ দিয়ে যাও, ফুল প্রেমিক হবে। শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলবী

 

ভূমিকা:

ভারত উপমহাদেশে নববী ইলমের বাগানে যতগুলো ফুল সুবাস ছড়িয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম শাহ্ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.)।

তিনি ছিলেন হাদিস শাস্ত্রের বিজ্ঞ পণ্ডিত এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন মুজাদ্দিদ বলে বিবেচিত হন। মহান রাব্বুল আ’লামীনের স্বর্গীয় নূরের এক প্রতিচ্ছবি ছিলেম শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.)। তিনি ইলমে রুহানীর দুর্দম্য কুঞ্জ ও ইলমে মা’রিফাতের কুলহীন সাগরের মণি-মুক্তা ছিলেন।

জন্ম, বংশ ও পিতৃ পরিচয় :

শাহ আবদুল আজিজ ২৫ রামাদ্বান, ১১৫৯ হিজরি (১১ অক্টোবর, ১৭৪৬) সনে মুঘল সম্রাট মুাহাম্মাদ শাহের (১৭১৯-১৭৪৮) শাসনামলে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লী ছিল তখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। তিনি শাহ ওয়ালি উল্লাহ এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন।

তার পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ যখন মারা যান তিনি তখন মাত্র ১৭ বছরের যুবক। পিতার মৃত্যুর পর তিনি হাদিসের শিক্ষক হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হন এবং পরবর্তীকালে দিল্লির বিখ্যাত মুহাদ্দিসে পরিণত হন। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং মুজাদ্দিদ ছিলেন।

তাঁর বংশ ও পরিবার পবিত্র ইলমে হাদিস এবং ফিকহের ক্ষেত্রে এক অনন্য মর্যাদার স্থান দখল করেছিলো। তিনি তার পিতা শাহ ওয়ালীউল্লাহ এর যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নকশবন্দি সুফি। তাঁর প্রকৃত নাম আব্দুল আজিজ। কিন্তু ইতিহাসের পাতাগুলোতে তাঁর নাম গোলাম হালীম বলেও সুখ্যাতি রয়েছে।

প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ :

তিনি শিক্ষক হিসাবে তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতাকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তিনি তাঁর পিতা হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর (রহঃ) কাছ থেকেই সর্বস্তরের জাহেরি ও বাতেনি ইলম গ্রহণ করেছেন।

বাল্যকালেই কুরআন মাজীদ হিফজ করেন এবং তাজবীদ ও ক্বেরাত শিক্ষা করেন। এগারো বছর বয়সে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তার পিতা স্বীয় শিষ্যদের মধ্যে একজন যোগ্য ব্যক্তিকে তাঁর শিক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। মাত্র দু’বছরে তিনি আরবি ভাষায় এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিষ্ময়কর দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর স্বাভাবিক উদ্যম ও মেধার তুলনা বিরল।

অতঃপর পিতার দরসে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এই দরসে শুধু আলিম সমাজে খ্যাতিমান স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ছাত্ররা অংশগ্রহণ করতেন। ষোল বছর বয়সে তিনি তাফসির, হাদীস, আকায়েদ, ফিক্বহ, উসুল, মানতিক, জ্যামিতি, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন। কিন্তু তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল কুরআন মাজিদের প্রতি। তিনি নিজেই বলেছেন, তার পিতা তার উস্তাজকে কুরআন মাজিদ শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিশেষ তাকীদ দিতেন।

পিতার মৃত্যুর পর তিরি ষোল বছর বয়সে অধ্যাপনার পৈতৃক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন হতে মৃত্যু অবধি তিনি অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, রচনা ও সংকলন, পরিচালনায় নিযুক্ত থাকেন। আলিম সমাজ তাঁকে সিরাজুল হিন্দ উপাধী প্রদান করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যান্ত প্রখর। অনেক বিখ্যাত পুস্তকাদির সুদীর্ঘ উদ্ধৃতি তিনি মুখস্ত লেখতে পারতেন। বাতেনী ও রূহানী জগৎ বিষয়ক জ্ঞানগর্ব বক্তব্য পেশ করলে মনে হত যেন সমুদ্র উদ্বেলিত হচ্ছে। কথা বললে উপস্থিত লোকজন বিমুগ্ধ হয়ে যেতো।

আর তাদের অন্তর আল্লাহ প্রেমের নূরে উদ্ভাসিত হয়ে যেত। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এতই বাস্তবধর্মী ছিল যে, তিনি সৎ-নিয়তে ইংরেজী শিক্ষা করার ফতোয়া প্রদান করেন। তাঁর মৃত্যুর ৫০/৬০ বৎসর পরও অধিকাংশ আলিম এইরূপ স্থির মতামত প্রকাশে বিরত থাকেন। শাহ আব্দুল আজিজ (রহঃ) প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার ও শুক্রবার শিক্ষা নিকেতনে ওয়াজ করতেন।

এতে অসংখ্য আগ্রহী শ্রোতা যোগদান করতো। তাঁর বাচনভঙ্গি এতই চিত্তাকর্ষক ছিলো যে, বিভিন্ন মাজহাব ও জাতির লোক তাঁর আলোচনায় তৃপ্ত হত। তাঁর কোনো কথা কারো মনো কষ্টের কারণ হতো না। প্রথম হতেই তাঁর আলোচনার রীতি ছিলো খুবই পরিচ্ছন্ন এবং প্রাঞ্জল। কোন কঠিন বিষয়কে তিনি এমন সহজ ও সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতেন যে পন্ডিত ব্যক্তিরাও আশ্চর্য হয়ে যেত। সমসাময়িককালে তিনি ছিলেন আলেম-শায়েখদের কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর রচনাবলী পণ্ডিতদের কাছে প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে বিবেচিত হয়।

তাঁর শিক্ষা ফয়েজ ভিত্তিক হলেও দ্বীনের খুঁটিনাটি দিকসমূহের গুণাগুণেও ভরপুর ছিলো। তিনি আজীবন হাদীসের বর্ণনা এবং হিদায়াতী কাজে নিয়োজিত ছিলেন । শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাঁর পেশা ছিল।

তাঁর পিতা হাদীস শাস্ত্রের যে প্রদীপ ভারতবর্ষে প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন তিনি তাঁর সমাপ্তি টানেন। তাঁর অনেক শিষ্য ছিল। তাঁর কাছ থেকে সে সকল ব্যক্তি জাহেরী বাতেনী ফয়েজ অর্জন করেছিলেন তাঁরা সেটাকে গৌরবের বিষয় মনে করেন। অনেকে তাঁর রুহানী ফয়েজ-বরকত লাভ করে ধন্য হয়েছেন। তাঁর শাগরিদদের মধ্যে বহু প্রসিদ্ধ আলেম-ওলামা, ফুযালা, ফক্বীহ ও মুহাদ্দিসগণ রয়েছেন।

তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম হলেন—

  • সায়্যিদ আহমাদ শহীদ (রহ.)
  • শাহ ইসমাইল শহীদ (রহ.)
  • মাওলানা হাইদার আলি (রহ.)
  • ফাইজাবাদ (রহ.)
  • গুলাম আলি দিহলাবী (রহ.)
  • মাওলানা সায়্যিদ শাহ আলে রাসুল কাদরী বারকাতী (রহ.)
  • মাওলানা ফজলে হক খাইরাবাদী (রহ.)
  • মাওলানা মাহবুব আলি দেহলভী (রহ.)
  • মুফতি সদরুদ্দীন আজুরদাহ (রহ.)
  • মাওলানা মুহাম্মাদ আলি (রহ.)
  • মাওলানা আহমাদ আলি (রহ.)
  • মাওলানা কারামাতুল্লাহ মুহাদ্দিস আলিপুরী (রহ.)

এছাড়াও নিজ ভ্রাতা হযরত মাওলানা শাহ্ রফিউদ্দীন সাহেব (রহ.), তাঁর জামাতা হযরত শাহ্ মুহাম্মাদ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.), হযরত মাওলানা মুফতী সদরুদ্দীন দেহলভী (রহ.), হযরত মাওলানা রশীদ উদ্দীন খান দেহলভী (রহ.), হুজুরের কন্যার স্বামী (জামাই) মওলভী আবদুল হাই (রহ.), হযরত মাওলানা মীর মাহবুব আলী দেহলভী (রহ.) এবং হযরত মাওলানা হাসান আলী লখনভী (রহ.) প্রমুখ।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :

তিনি জাহেরী এবং বাতেনী ইলমে ছিলেন অতুলনীয় একজন ব্যাক্তি। মান এবং সম্মানে ভরপুর ছিলেন। সাহায্য-সহযোগিতায় উপমাহীন ছিলেন। ইলম ও আমলে অপ্রতিদ্বন্ধী ছিলেন। ওনাকে মুফাসসিরীনের মহর এবং ইমামুল মুহাদ্দিসীন বলা হয়। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফকীহও ছিলেন তিনি। তিনি আলেমগণের মধ্যমণি এবং মাশাইখদের পথপ্রদর্শক ছিলেন ।

তিনি ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র, ব্যতিক্রমধর্মী লেখক, প্রচলিত-অপ্রচলিত বহুমুখী জ্ঞানের আঁধার ছিলেন। তিনি স্বপ্নের প্রসিদ্ধ ফাল বেরকারী ছিলেন, ওয়ায়েজে বে-নজীর, কবিতা-প্রবন্ধে পটু, জ্ঞানের তত্ত্ব উদ্ঘাটনকারী, সামনা-সামনি জ্ঞানভিত্তিক তর্কবাগিশ হিসাবে বেশ সুখ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন শরীয়তের পূর্ণ অনুসরণকারী, খোদাভীরু, ধী-শক্তি সম্পন্ন, আমানতদার এবং ছিলেন বেলায়াতের শাহানশাহ্  ।

বাইয়াত ও খিলাফত :

তিনি নিজ পিতার কাছ থেকেই বাইয়াত ও খিলাফতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন । তরীকতের পথে যাত্রা তিনি পিতার হাত ধরেই শুরু করেন। এ যাত্রাকেই খোদা প্রাপ্তির উসীলা বলা যায়। তাঁর শ্রদ্ধেয় পিতা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) বলেন—

‘নিশ্চিত বলা যায়, মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাকে এবং আমার সময়ের লোকদের উপর অশেষ মেহেরবাণী করেছেন। কেননা আল্লাহ পাক আমাকে যে তরীকার অনুসারী করেছেন সেটা মহান প্রভুর একান্ত নৈকট্যশীল তরীকা। যার মাঝে বিশেষ ধরনের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে—

প্রথমত : বাস্তব ঈমান
দ্বিতীয়ত : নফলসমূহে সমৃদ্ধ
তৃতীয়ত : নৈকট্য লাভের নিশ্চিত গ্যারান্টি
চতুর্থত : ফরজসমূহের বাধ্যবাধকতা
পঞ্চমত : ফেরেস্তার জগতে পৌছার অপূর্ব সুব্যবস্থা।

যে ব্যক্তি এগুলো পালনে সৎ সাহসের সাথে অগ্রসর হবে মহান আল্লাহ তাঁকে অবশ্যই সৌভাগ্যমণ্ডিত করবেন। কেননা মহান রাব্বুল ইজ্জত আমাকে ইলহামের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমি তোমাকে এ তরীকার ইমাম বানিয়ে দিলাম এবং তোমাকে ঊর্ধ্ব জগতের সম্মান প্রদান করা হল।

সকল তরীকাকে তোমার তরীকার উপর তোমার আনুগত্যের ভালোবাসায় উঁচু করে দিলাম। সুতরাং, তোমার সাথে যারা শত্রুতা পোষণ করবে তাঁদের প্রতি রহমতের দরজা রহিত করে দিলাম, অর্থাৎ তোমার দুশমনেরা সকল প্রকার মঙ্গল ও সৌভাগ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে।’

ব্রিটিশ শাসিত হিন্দুস্তানকে দারুল হারব ঘোষণা :

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হিংস্র থাবা হতে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য হযরত শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) যে বিপ্লবী ফতোয়া প্রদান করেন। তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে ভারতবর্ষকে ‘দারুল হারব’ তথা শত্রু অধিকৃত দেশ বলে ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি প্রকাশ্য বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন। শাহ আব্দুল আজিজ (রহ.) কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াটি ফারসী ভাষায় লেখা হয়।

নিম্নে ফতোয়াটি উপস্থাপন করা হল—

“এ অঞ্চলে মুসলিম ইমামের কোন কর্তৃত্ব নেই। খ্রীষ্টান অফিসারদের নির্দেশই নিরঙ্কুশভাবে এখানে কার্যকরী হয়ে থাকে। অমুসলিম কর্তৃত্ব ও নির্দেশ প্রয়োগের অর্থ হল রাষ্ট্রের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, খিরাজ, ওশর, বাণিজ্যিক কর, খাজনা, চোর ডাকাত থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থাপনা, মামলা মুকাদ্দমার মীমাংসা, অপরাধের শাস্তি প্রদান, ইত্যাদি (সামরিক ও বেসামরিক ব্যবস্থাপনা) পুলিশ বিভাগের পরিচালনা, দেওয়ানী, ফৌজদারী বিষয়াদির নিয়ন্ত্রণ, কাস্টম ডিউটিসহ সবকিছুর ক্ষেত্রেই কাফের সর্বোচ্চ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী।

উপরোক্ত বিষয়াদিতে বর্তমানে ভারতীয় নাগরিকদের আদৌ কোন কর্তৃত্ব নেই। তবে অমুসলিম শোষকরা মুসলমানদের জুমা, ঈদ, আযান ও গরু জবাইয়ের বেলায় কোন বাধা দিচ্ছে না বটে। এতদসত্ত্বেও যে বিষয়টি উপরোক্ত সকল বিষয়ের মূল নীতিমালা (শাসন কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহর) এখানে নিঃসন্দেহে অর্থহীন ও পদদলিত অবস্থায় রয়েছে।

এ কারণেই নিঃসংকোচে মসজিদগুলো বিধ্বস্ত করে দেয়া হচ্ছে। সর্বসাধারণকে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এমনকি হিন্দু কিংবা মুসলিম নির্বিশেষে কোন নাগরিক তাদের সরবরাহকৃত পারমিট ব্যতিরেকে এ শহর কিংবা শহরের উপকণ্ঠে প্রবেশ করতে পারে না।

মুসাফির কিংবা বণিকদের নগরে যাতায়াতের যে অনুমতি দেয়া আছে সেটিও দেশীয় স্বার্থ কিংবা নাগরিক স্বাধীনতার ভিত্তিতে নয় বরং তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুরই অনুমতি দেয়া হয়। সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরজ।”

হযরত শাহ আব্দুল আজিজ দেহলভী (রহ.) এর এ ফতোয়া কেবল মুসলমানদের মাঝেই নবজাগরণ সৃষ্টি করেনি; অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। বরং ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতব্যাপী বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

কবিতা এবং গজলপ্রীতি:

তিনি ছিলেন গজল প্রেমিক ও কাব্যিক গুণাবলী সমৃদ্ধ। নিচের কবিতামালা তার প্রমাণ বহন করে—

گر بگلشن میگذری گل بر رخت مفتون شود
পুষ্প কাননের পাশ দিয়ে যাও, ফুল প্রেমিক হবে

در نماۓ قامت خود سر در اموزون شود
সেথা স্বীয় রূপ খুঁজলে নেহাৎ অশোভন হবে।

کار با معنی است دانارانه بانام و نشان
নিজেকে গুণান্বিত কর নাম বিকিয়ে নয়

ر و مفلس را جهان یک سر محل آفت است
বিপদ সংকুল এ ধরা খাঁটি মুমিনের তরে

حید به لیلی ندارد بید اگر مجنون شود
লাইলীর প্রেমাসক্ত বিনে মজনু কি হয়?

شیشہ چوں خالی است گر بادش رسد و اثون شود
শীশার মতো ভর্তি থেকো কাঁচ অভ্যস্তরে

 

নবী কারীম (ﷺ) এর পবিত্র শানে তাঁর রচিত চিত্তাকর্ষক পঙক্তিমালা :

يا صاحب الجمال ويا سيد البشر
হে পরম শৌর্যের আঁধার শ্রেষ্ঠতম সর্দার

من وجهك المنير لقد نور القمر
তোমার নূরী আলোতেই চন্দালো অপার।

لايمكن الثناء كما كان حقه
যতটা তুমি প্রশস্তি যোগ্য, অতোখানি সম্ভব নয়

بعد از خدابزرگ توی قصہ مختصر
খোদার পরে তুমিই মহান, একথা জানি নিশ্চয়।

অবদান ও গ্রন্থসমূহ :

লেখনীর জগতে তিনি ছিলেন একজন ক্ষুরধার লেখক। তাঁর প্রসিদ্ধ রচনাবলীর একটি তালিকা প্রদান করা হল—

  • উসূলে হাদীস
  • ইজলায়ে নাফেয়া
  • বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন
  • মজমুয়ায়ে খমসা রাসায়েল
  • শরহে মীজনুল মানতিক
  • রাসায়েলে ফাজায়েলে খুলাফা
  • আরবা মা’রূফ বি-আজীজুল ইকতিবাস ফী ফাজায়েলে ব-নামায়ে আনফা-স
  • তাফসীরে ফাতুহুল আজীজ
  • রিসালায়ে গেনা
  • রিসালায়ে বাইয়ে কানীজান
  • রিসালায়ে ওয়াসীলায়ে নাজাত
  • রিসালায়ে তাফদীল
  • রিসালায়ে উসূলে মাযহাবে আবী হানীফা
  • রিসালায়ে মাআদে জিসমানী প্রভৃতি ।

তাঁর ফতোয়া ছিল বাস্তবোচিত, সু-প্রসিদ্ধ। তাঁর লেখনীগুলো বিভিন্ন শারয়ী মাসলা-মাসায়েলে সমৃদ্ধ। এছাড়াও শাহ আবদুল আজিজ (রহ.) কুরআনের উর্দু অনুবাদ করেন। তিনি আরও অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০ থেকে ২০০ পর্যন্ত রয়েছে বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়।

ফাতাওয়া আজিজ (শাহ সাহেব কর্তৃক প্রদত্ত ফাতাওয়ার সংকলন), তুহফা ইসনা আশারিয়া (উর্দু: تحفہ اثناء عشریۃ‎‎, বারো ইমামীদের প্রতি তুহফা), সিরুশ শাহাদাতাইন, তাফসীর ফাতহুল আজিজ অথবা তাফসির-ই-আজিজ (ফার্সিতে), বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন (মূল লেখক তাঁর পিতা)। এইগুলো হলো তাঁর রচিত অনবদ্য কিছু কিতাব।

নির্বাচিত উল্লেখযোগ্য বাণী সমষ্টি :

  •  মহান আল্লাহর যিকিরের মাধ্যমেই অন্তর শান্তি পায়।
  •  যোগ্যতা অর্জনের জন্য ভালোবাসা একান্ত প্রয়োজন।
  •  তরীকতের বন্ধুত্ব হচ্ছে, কর্মের সাধনার নাম।
  •  জযবা হচ্ছে মহান স্রষ্টার দান।
  •  প্রতি ধর্মে পাঁচটি বিষয়ের গুরুত্ব অপরিসীম যেমন— জ্ঞানের সুরক্ষা, মনোবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ, ধর্মের ঐতিহ্য রক্ষা, বংশীয় মর্যাদা রক্ষা এবং সম্পদের সুরক্ষা।
  •  ইহসান ব্যতীত ইবাদতের অস্তিত্ব এরকমই মনে করতে হবে। যেমন- আত্মাবিহীন দেহ ।
  •  মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি থাকা চাই । বিশেষ করে পাড়া পড়শীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।

শারীয়াতের বিরুদ্ধাচরণের ফল :

মালফুজাতে শাদে আবদুল আজীজ (রহ.) গ্রন্থে লিখেছেন— ‘নিঃসন্দেহে ইসলামী শরীয়তের বিপরীত কাজ-কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়লে দুদর্শায় নিপতিত হতে হয়। শরীয়ত সমর্থন করে না এমন কার্যাবলীর কারণে তরীকতপন্থীদের যাদের মহান আল্লাহ পাকের সাথে গভীর সুসম্পর্ক রচিত হয়েছিল তা কর্তিত হয়ে যায় । যেমন- ধোঁকাবাজি, অহঙ্কার, নিজেকে শ্রেয় মনে করা, আড়ম্বরতা, দুনিয়াখোরী ও পদলোভ ইত্যাদি ।

অনেকের বেলায় এমন হতে পারে যারা ভুলক্রমে সগীরা গুনাহও যদি করে ফেলে তাতে অন্তরের নূরটুকু বিলুপ্ত হয়ে পড়ে এবং এক ধরনের অন্ধকার (অন্তরে) নেমে আসে।’

খাঁটি আলেমের পরিচয় :

তিনি বলেন, খাঁটি আলেমগণের মধ্যে নিচের চারটি গুণের একত্রিত সমাবেশ পরিলক্ষিত হবে—
১। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
২। পাঠ দানের নিমিত্তে কিতাব নিজেপূর্বাপর পাঠ করা
৩। লেখনী শক্তি এবং বয়ানের যোগ্যতা থাকতে হবে এবং
৪। ধর্মীয় তর্কে বাকপটু হতে হবে।

পবিত্র কুরআন পাঠের নিয়ম:

ফাতোয়ায়ে আজিজিয়া গ্রন্থে তিনি লিখেছেন— পবিত্র কুরআন পাঠকারীর কর্তব্য হচ্ছে, কিবলামুখী হয়ে ভয়-ভীতি অন্তরে রেখে, মাখরাজ অনুযায়ী প্রতিটি শব্দ আদায় করা, প্রশংসাসূচক শব্দাবলীর প্রতি নজর রাখা, যেখানে যে নির্দেশ আছে সেসব মেনে চলা।

উপরে আলোচিত হয়েছে জাহেরী সম্মানের বিষয়াবলী। এবার বাতেনী সম্মান হচ্ছে— এমনভাবে কুরআন পাঠ করা চাই যেন মহান প্রভুর সামনেই তা পাঠ করে শুনানো হচ্ছে। মহান আল্লাহ পাক যেন ওস্তাদের মত হুবহু তা শুনছেন। অথবা এ ধারণা পোষণ করবে স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়ালার পবিত্র জবান থেকেই সরাসরি পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো শুনতে পাচ্ছে।

পাদ্রির সাথে বিতর্কে জয়লাভ :

মি. মটকাফ নামক জনৈক এক পাদ্রী হযরতের কাছে এসে মুনাজারার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। কথা হলো যদি পাদ্রী হেরে যান তাহলে তিনি হযরতকে দুই হাজার টাকা দিবেন আর হযরত হারলে পাদ্রীকে সমপরিমাণ টাকা দিতে হবে।

পাদ্রী প্রশ্ন করলেন:
‘আপনার নবী কি আল্লাহর বন্ধু’? আপনার নবী কি হুসাইনকে হত্যার সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেননি যে, আমার দৌহিত্রকে হত্যা থেকে বাঁচানো হোক? না-কি প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ কবুল করেননি।

তিনি জবাব দিলেন:
‘হ্যাঁ! আমাদের নবী আল্লাহর বন্ধু এবং তিনি প্রার্থনা করেছিলেন কিন্তু আল্লাহ বলেছিলেন— “তোমার নাতীর উপর উম্মাতেরা যুলুম-নির্যাতন করে তাঁকে শহীদ করেছে আর শহীদের মর্যাদা অনেক বেশি। কিন্তু এ সময় আমার পুত্র ঈসার কথা মনে পড়ছে, যাকে তার অনুসারীরা শূলে বিদ্ধ করেছিল।”

উল্লেখ্য, শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলভী (রাহিমাহুল্লাহ) জনৈক খ্রিষ্টান পাদ্রীর প্রশ্নের জবাবে তার বিশ্বাস অনুযায়ী উক্ত জবাব প্রদান করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ঈসা (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর পুত্র নন বরং তিনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল ছিলেন। এছাড়া খ্রিষ্টানরা তাকে শূলেও বিদ্ধ করেনি বরং আল্লাহ তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন (সূরা মারইয়াম : ৩০; সূরা আন-নিসা : ১৫৭-১৫৮ দ্রষ্টব্য)।

অর্থাৎ, পাদ্রী আমাদের নবীজীর (ﷺ) হাবীবুল্লাহ হওয়ার ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করলে হযরত শাহ্ আবদুল আজীজ (রহঃ) পাদ্রীদের কথানুযায়ী হযরত ঈসার (আ.) খোদার পুত্র হবার ধারণার উপর এমন যুক্তি উপস্থাপন করলেন যাতে পাত্রী সাহেব নিরুত্তর হয়ে পরাজয় মেনে নেন।

কাশফ ও কারামত :

তিনি যখন জুমার নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গমন করতেন, মাথার পাগড়িটি চোখ পর্যন্ত টেনে দিতেন। ফসীহ উদ্দীন নামক এক ব্যক্তি এর কারণ জানতে চাইলেন। হুজুর নিজ মাথার টুপি লোকটির মাথায় দেয়া মাত্র সে বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল।

পরে ঐ লোকটি বলল, জুমার মসজিদে পাঁচ হাজার মত মানুষ থাকলেও কয়েক শ লোক দেখলাম, যেগুলো মানুষের মত দেখলাম আর বাকীরা কিছু বানর, ভালুক এবং কিছু কিছু অপরাপর বন্য জানোয়ারের রূপে বসে আছে। এবার হুজুর ঐ লোকটিকে বললেন, কারণ বুঝেছ?

তাঁর অসীয়াত :

তিনি দুপাট্টা জামা এবং গেরুয়া পায়জামা পরিধান করতেন। তিনি অসীয়ত করে যান যে, আমি জীবনে যেভাবে কাপড় পরিধান করেছি মৃত্যুর সময় সেভাবেই কাফন দিবে।

জানাজায় নামাজের ব্যাপারে তিনি বলে গেছেন, আমার জানাজার নামাজ শহরের বাইরে নিয়ে যাবে আর সেখানে জানাজার নামাজে এদেশের বাদশাহকে যেতে নিষেধ করে দিবে।

শাহ্ আব্দুল আজিজের ওফাত :

রামাদ্বান ১২৩৯ হি: মোতাবেক এপ্রিল ১৮২৪-এর শেষদিকে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা বেড়ে গেলে নগদ সমস্ত সম্পত্তি তিনি শরীয়ত মোতাবেক ভ্রাতুষ্পুত্র ও নিকট আত্নীয়দের মাঝে বণ্টন করে দেন। তাঁর পরিহিত বস্ত্র দ্বারাই তাঁর কাফন দাফনের ওসিয়ত করে যান।

৭ই শাওয়াল ১২৩৯ হি: মোতাবেক ৫ই জুন ১৮২৪ সালের রবিবার সকালে তাঁর ইন্তেকাল হয়। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বৎসরের কিছু বেশি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। জনস্রোত এত বেশি ছিলো যে, পর পর পঞ্চান্ন বার তাঁর জানাযার নামাজ আদায় করা হয়। দিল্লীর তুর্কি দরজার বাইরে পারিবারিক গোরস্থানে পিতার কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

পরিশেষ :

জাহেরি ও বাতেনি উভয় ক্ষেত্রেই শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) ছিলেন সমৃদ্ধ । এছাড়াও তাকে তৎকালীন যামানার মুজাদ্দিদ ও বলা হয়ে থাকে। ইতিহাসের পাতায় তাঁর অবদান চির অমলিন হয়ে থাকবে এবং যুগের পাতায় পাতায় তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।

 


# লেখকের রচিত গ্রন্থাবলীর (PDF) কালেকশন সমগ্র:

[নিচের তালিকাবদ্ধ বইয়ের নাম হতে আপনার প্রয়োজনীয় পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করতে যেকোন একটি সার্ভারের ডাউনলোড লিঙ্ক বেছে নিন]

১. বুস্তানুল মুহাদ্দিসীন – শাহ্ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী

Download: 1.     Drive Link         ||

 

[ বি: দ্র: ] বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। আমাদের সাইটের কোন বই ভালো লাগলে অনুগ্রহপূর্বক মূল বইয়ের হার্ডকপি লাইব্রেরী হতে সংগ্রহ করুন।

মনে রাখবেন, আপনার ক্রয়কৃত বই প্রেরণা যোগায় লেখক ও প্রকাশককে নতুন বই প্রকাশ করতে। লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সমাজকে সুসমৃদ্ধ করার প্রয়াসে মূলবই ক্রয়ের কোনো বিকল্প নেই।

অনলাইনে বই ক্রয়ের জনপ্রিয় কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম –

  1. rokomari.com
  2. boibazar.com
  3. kitabghor.com
  4. wafilife.com
  5. ruhamashop.com

ক্রেডিট
WikipediaNazmul Huda
Back to top button
error: Python Encryption !!!