মুজাদ্দিদ-ই-যামান ইমামুল হিন্দ শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)-এর জীবনাচরন
ও রচনাবলী [পিডিএফ]

প্রারম্ভিকা:
ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির সংরক্ষণ, মুসলিম জাতিকে চিন্তা চেতনার বন্ধ্যাত্ব থেকে মুক্তিদান ও বিজাতীয় আগ্রাসন থেকে ভারত ভূমিকে পবিত্র করার জন্য এই ভূখণ্ডে যে সকল মহামনীষীর আবির্ভাব ঘটেছিল শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) ছিলেন তাদের অন্যতম । তিনি তাঁর যুগোপযোগী ও সফল আন্দোলনের ফলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
জন্ম ও শিক্ষা–দীক্ষা:
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) ১১১৪ হিজরী ৪ঠা শাওয়াল মোতাবেক ১৭০৩ খৃষ্টাব্দে ভারতের মুজাফফরনগর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন ওয়াজিউদ্দিন যিনি সম্রাট শাহজাহানের সময় সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
তাঁর পিতার নাম ছিল শাহ আব্দুর রহীম। তিনি সেই সময়কারের একজন বিখ্যাত আলিম ছিলেন এবং তিনি ফাতওয়ায়ে আলমগীরির একজন অন্যতম বিচারক ছিলেন। তিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানী তথা উমর (রা.)-এর বংশধর ছিলেন। তিনি একজন যুগশ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক মুজাদ্দিদ-ই-জামান ছিলেন এবং তাকে ইমামুল হিন্দ বা শায়খুল হিন্দ বলা হয়।
তিনি পাঁচ বছর বয়সে মক্তবে ভর্তি হন ও পিতার নিকটে ফার্সী ভাষা শিক্ষা করেন। সাত বছর বয়সে হেফজ সমাপ্ত করেন। মাত্র পনের বছর বয়সে তখনকার প্রচলিত পাঠসূচীর সকল বিষয় যথা হাদীস, ফিকহ, তাফসীর, উসূল, ইলমে কালাম, জ্যামিতি ইত্যাদিতে পূর্ণ বুৎপত্তি অর্জন করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে পিতার নিকট বাইয়াত হন। এর মাত্র দু’বছর পর তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন ।
কর্মজীবন ও হিজায সফর:
পিতার মৃত্যুর পর শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) মাদ্রাসায়ে রাহীমিয়্যাতে অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত হন। দীর্ঘ বারো বছর যাবত তিনি অধ্যাপনার কাজে মশগুল থাকেন।
১৭৩১ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে হজ্জ সমাপনের জন্য পবিত্র মক্কা মুকাররামায় গমন করেন এবং সেখানে দুই বছর অবস্থান করেন। এ সময় মদীনা শরীফের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ শাইখ আবু তাহের মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম (রহঃ) এবং আব্দুল্লাহ বিন শায়খ সুলায়মানের কাছে থেকে হাদীসশাস্ত্র এবং শায়খ তাজুদ্দীন হানাফী, শায়খ আলাকী মাক্কীর কাছে থেকে তিনি ইসলামী বিষয়ে বিশেষ শিক্ষা অর্জন করেন।
১৭৩২ মতান্তরে ১৭৩৩ সালে তিনি স্বদেশে ফিরে আসেন এবং স্বপ্নে দেখেন যে— তিনি হাসান (রাঃ) ও হুসাইন (রাঃ) এর কাছে থেকে কলম উপহার পাচ্ছেন। তখন সেখানকার আলিমগণ এই অভমত দেন যে— অতি শীঘ্রই তিনি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলিম হিসেবে খ্যাতি লাভ করবেন।
ভারতবর্ষ ও আরব বিশ্বের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অনুধাবনের জন্য চৌদ্দ বছর সময়কাল এই মহামনীষীর জন্য যথেষ্ঠ ছিল। মূলত হিজায থেকে ফিরে আসার পরই তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের সূচনা হয়।
সমাজ-সংস্কারে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ:
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহঃ) ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, আগামী যুগটা হচ্ছে বস্তুবাদ ও ভোগবাদ যুগ। এর সয়লাবের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষার একমাত্র পথ হচ্ছে অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় সমূহে ইসলামের সার্বজনীন, ভারসাম্যপূর্ণ ও সুমহান নির্দেশনা তাদের সামনে সুবিন্যস্তভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে; বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে তৈরী অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির মুকাবিলায় এর যথার্থতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
এজন্য তিনি তাঁর অমর কীর্তি ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ’ নামক গ্রন্থে এসব বিষয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষায় আলোচনা করেছেন। তিনি এও অনুধাবন করেছিলেন যে, ভোগবাদী ধ্যানধারণার মরণকামড় থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে হলে তাদের মাঝে কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাপক প্রচলন ঘটাতে হবে, তাই তিনি সর্বপ্রথম তখনকার প্রচলিত ভাষা ফার্সীতে পবিত্র কুরআনে কারীমের তরজমা করেন।
তিনি মাদ্রাসা রাহীমিয়া এর সিলেবাসে আমূল পরিবর্তন এনে গ্রীক দর্শনের পরিবর্তে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক সিলেবাসের প্রচলন করেন, যা ভারতবর্ষে কুরআন সুন্নাহর গবেষণার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তিনিই ভারতবর্ষে নিয়মতান্ত্রিকভাবে হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাব সমূহের দরসের সূচনা করেন।
তিনি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আগামী প্রজন্মের রুচি প্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হতে যাচ্ছে। মানুষ তখন সব কিছুকে যুক্তির আলোকে যাচাই করতে চাবে, এজন্য তিনি শরীয়তের বিধানাবলীর যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। কোন বিধান কেন এসেছে এ নিয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ আলোচনা করেছেন তিনি।
তাঁর এসব কার্যাবলী ছিল তখনকার মুসলিম সমাজের জন্য একদম নতুন বিষয়। এসব পদক্ষেপের জন্য তাঁকে অত্যন্ত সাহসিকতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হয়েছে।
রাজনীতিক নেতৃত্ব:
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) সম্রাট আলমগীরের মৃত্যুর চার বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন। বলা বাহুল্য, সম্রাট আলমগীরের ইন্তেকালের পর ভারতবর্ষে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভাগ্যরবি অস্তমিত হতে শুরু করে। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) পতনোম্মুখ জাতিকে রক্ষা করার জন্য যে কার্যক্রম গ্রহণ করেন তা দুভাগে ভাগ করা যায়— ক. পরোক্ষ রাজনৈতিক কার্যক্রম এবং খ. প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যক্রম।
ক. পরোক্ষ রাজনৈতিক কার্যক্রম:
এ কার্যক্রমের আওতায় তিনি যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা হল—
(ক) ইসলামী জীবনাদর্শকে উপমহাদেশের জনগণের সামনে অত্যন্ত আকর্ষণীয় আঙ্গিকে তুলে ধরেন। অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, চরিত্র ও নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামের যথার্থ শিক্ষা ও নির্দেশনাকে অত্যন্ত সুবিন্যস্ত ভাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
(খ) শরীয়তের বিধানাবলীর যৌক্তিকতা ও এর কার্যকরণ নিয়ে আলোচনা করেন।
(গ) একদল প্রতিভাবান, মেধাবী মানুষকে ইসলামী শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন।
(ঘ) কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাপক প্রচলন ঘটান।
(ঙ) তাছাউউফ ও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার জন্য সফল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাছাউউফের বাইআতকে শুধুমাত্র আত্মশুদ্ধির অঙ্গিকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি একে রাজনৈতিক ভিত্তি হিসেবেও গ্রহণ করেছিলেন।
(চ) জনসমক্ষে ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সর্বত্র ইসলামী চেতনা তৈরীর প্রয়াস পেয়েছেন।
খ. প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কার্যক্রম:
এ কার্যক্রমের আওতায় তিনি যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেন তা হল—
(ক) মোঘল সম্রাটদের কাছে বিভিন্ন বিষয়ে চিঠিপত্র লিখেন। এসব চিঠি পত্রে যেমনিভাবে তিনি ইসলামী সাম্রাজ্যের উপর আগত প্রায় বিপদাপদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন অনুরূপ তা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কেও দিক নিদের্শনা দিয়েছেন ।
(খ) মারাঠাদের প্রতিরোধ করার জন্য আহমদ শাহ আবদালীকে দিল্লি নিয়ে আসেন। ভারতবর্ষের তৎকালীন মুসলিম শাসকদের অসহায়ত্বে নিরুপায় হয়ে তদানীন্তন রোহিলা সর্দার নওয়াব নজীবুদ্দৌলা ও আফগান গভর্নর আহমদ শাহ আবদালীর সাহায্য গ্রহণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে আহমদ শাহ আবদালী ১৭৫৭ সালের পানি পথের তৃতীয় যুদ্ধে মারাঠাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে দিল্লীকে তাদের কবল থেকে মুক্ত করেন।
(গ) তিনি তাঁর শিষ্যদেরকে জিহাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একটি সুসংঘবদ্ধ বাহিনীতে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। আন্দোলনের ফলাফল ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহঃ) এর রাজনৈতিক কার্যক্রমের ফলাফল ছিল সূদূর প্রসারী। তিনি যে আন্দোলনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে যান তা কালক্রমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম, দারুল উলূম দেওবন্দ ও অন্যান্য ঐতিহাসিক ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা ও পরিশেষে ইংরেজ শাসনের কবল থেকে ভারতবর্ষের মুক্তি লাভের মাধ্যমে এর একটি পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
জ্ঞান ও সাহিত্যচর্চা:
এই কর্মবীর মহামনীষীর অর্ধশতের মত রচনা রয়েছে। যার অধিকাংশই মৌলিক রচনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রামাণ্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত । নিম্নে তার প্রসিদ্ধ কিছু গ্রন্থের নাম দেয়া হল—
১. ফাতহুর রাহমান, এটি ফার্সী ভাষায় কুরআনে কারীমের অনুবাদ
২. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ
৩. ইযালাতুল খিফা আন খিলাফাতিল খুলাফা
৪. আল মুছাওয়া শারহুল মুআত্তা
৫. আল মুছাফফা শারহে মুয়াত্তা
৬. আল ফাউযুল কাবীর ফী উসূলীত তাফসীর
৭.কুররাতুল আইন ফী তাফযীলিশ শাইখাইন
৮.তারাজিমু আবওয়াবিল বুখারী
৯. আল কাওলুল জামীল
ইন্তেকাল:
ইসলামী ইতিহাসের এই বিরল ইলমী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ভারতবর্ষে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি রক্ষা ও এর বিকাশের সফল রূপকার ৬১ বছর বয়সে ১১৭৬ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তিনি জেষ্ঠ্য ও শ্রেষ্ঠ উত্তরসূরি শাহ আব্দুল আযীয (রহ.), শাহ রফী উদ্দীন (রহ.), শাহ আব্দুল কাদির (রহ.) ও শাহ আব্দুল গণী নামে চারজন সুযোগ্য সন্তান রেখে যান। মহান প্রজ্ঞাময় আল্লাহ রাব্বুল আ‘য়লামিন দ্বীনের এই বিপ্লবী নেতাকে জান্নাতুল ফিরদাউসে উঁচু মাকাম দান করুন। আমীন।।
# লেখকের রচিত গ্রন্থাবলীর (PDF) কালেকশন সমগ্র:
[নিচের তালিকাবদ্ধ বইয়ের নাম হতে আপনার প্রয়োজনীয় পিডিএফ ফাইলটি ডাউনলোড করতে যেকোন একটি সার্ভারের ডাউনলোড লিঙ্ক বেছে নিন।]
১. কুরআন ব্যাখ্যার মূলনীতি – শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)
Download: 1. Drive Link ||
২. মতবিরোধ পূর্ণ বিষয়ে সঠিক পন্থা অবলম্বনের উপায় – শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)
Download: 1. Drive Link ||
৩. মুসলিম বোন ও পর্দার হুকুম – শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)
Download: 1. Drive Link ||
৪. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (১ম খণ্ড) – শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)
Download: 1. Drive Link ||
৫. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ (২য় খণ্ড) – শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)
Download: 1. Drive Link ||
[ বি: দ্র: ] বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন। আমাদের সাইটের কোন বই ভালো লাগলে অনুগ্রহপূর্বক মূল বইয়ের হার্ডকপি লাইব্রেরী হতে সংগ্রহ করুন।
মনে রাখবেন, আপনার ক্রয়কৃত বই প্রেরণা জোগায় লেখক ও প্রকাশককে নতুন বই প্রকাশ করতে। লেখক, প্রকাশক ও পাঠক সমাজকে সুসমৃদ্ধ করার প্রয়াসে মূলবই ক্রয়ের কোনো বিকল্প নেই।
অনলাইনে বই ক্রয়ের জনপ্রিয় কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম –
- https://rokomari.com
- https://boibazar.com
- https://kitabghor.com
- https://wafilife.com
- https://ruhamashop.com